কুরআন শরীফের সংগ্রহ ও সংকলন

WikiPasokh থেকে
Wahidshia (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০১:৩০, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ ("{{question}} কোন তারিখে সর্বপ্রথম কোরান সংকলন করা হয়েছিল এবং রাসুল (সাঃ) কি কোরান সংকলন ও সংগঠনের তত্ত্বাবধান করেছিলেন নাকি সাহাবীদের বিবেচনার ভিত্তিতে করা হয়েছিল? {{question end}} ইসলা..." দিয়ে পাতা তৈরি)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
প্রশ্ন

কোন তারিখে সর্বপ্রথম কোরান সংকলন করা হয়েছিল এবং রাসুল (সাঃ) কি কোরান সংকলন ও সংগঠনের তত্ত্বাবধান করেছিলেন নাকি সাহাবীদের বিবেচনার ভিত্তিতে করা হয়েছিল?

ইসলামি মুফাসসির এবং আলেমগণের মধ্যে এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে যে, কখন এবং কার মাধ্যমে কুরআনের সংকলন এবং সংগ্রহ সম্পাদিত হয়েছে। একদল মনে করেন, আয়াত ও সুরার সঠিক ক্রমবিন্যাস মূলত ঐশ্বরিকভাবে নির্ধারিত এবং স্বয়ং মহানবির (সা.) মাধ্যমে তাঁর জীবদ্দশাতেই বিষয়টি সম্পাদিত হয়েছিল। এর বিপরীতে অন্যরা মনে করেন, কুরআনের সংকলন ও সংগৃহীত করার কাজটি মহানবির (সা.) পরবর্তীতে সাহাবিদের সৃজনশীলতা, ইজতিহাদ ও ইচ্ছার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল।

সুরা এবং আয়াতগুলির ক্রমবিন্যাস

মহানবির (সা.) সময়ে কুরআনের সংকলনm

অনেক কুরআন বিষয়ক গবেষক বিশ্বাস করেন যে, বর্তমানে যে কুরআন রয়েছে, তা ঠিক মহানবির সময়ে যে ক্রমে কুরআনের আয়াত ও সূরা সংগ্রহ করা হয়েছে তার অনুরূপ।[১] এই বিশ্বাসের পিছনে তারা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন, যেমন[২]:

  • কুরআনের প্রতি নবিজির (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, কেননা তিনি কুরআন তিলাওয়াত এবং মুখস্থ (হিফজ) করার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন।
  • কুরআনের হাফেজরা নবিজির (সা.) নিকট নিজেদের মুখস্থ আয়াত তেলাওয়াত করে শোনাতেন।
  • ওহি নাজিলের সময় কাতিব বা কুরআন লেখকদের উপস্থিতি, মহানবি (সা.) ওহি নাজিলের সময় তা উচ্চারণ করে শোনাতেন এবং লেখকগণ তা লিপিবদ্ধ করে নিত। মহানবি তাদের লেখার ভুলগুলো শুধরে দিতেন এবং তারা সেগুলো সংশোধন করে নিত। এটি কুরআনের লেখনীর ওপর নাবিজির কর্তৃত্ব ও সংবেদনশীলতার পরিচায়ক।
  • কুরআন খতমের বিষয়টি সে সময় প্রচলিত ছিল, যা কুরআন নাজিলের সূচনা ও সমাপ্তির প্রতি নির্দেশ করে।
  • হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবির (সা.) সময়ে সাহাবিগণ কুরআনের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতেন।
  • এছাড়াও কিছু কারণও রয়েছে যেগুলো ঐতিহাসিক নয়, তবে সেগুলোও প্রমাণ করে যে, মহানবি (সা.) এই বিষয়ে অবহেলা করেছিলেন তা মানা যায় না; কারণ মহানবি (সা.) কুরআন সংগ্রহ এবং তার ক্রম নির্ধারণ না করলে, একাধিক সংস্করণ বের হত, হারিয়ে যেত বা বিকৃতির শিকার হত। অতএব, কুরআন সংগ্রহ ও সংকলন মহানবির (সা.) রিসালাতের দায়িত্বেরই একটি অংশ ছিল।

এই সমগ্র যুক্তি ও প্রমাণ নির্দেশ করে যে, কুরআনের সুরা এবং আয়াতগুলির ক্রমবিন্যাস স্বয়ং মহানবি (সা.) নির্ধারণ করেছিলেন। আর যদি তা সাহাবিদের দ্বারাও সংগ্রহ হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই মহানবির (সা.) নির্দেশ এবং পরামর্শের ভিত্তিতে হয়েছে। অন্যথায়, সমস্ত সাহাবী কীভাবে একমত হতে পারেন যে, কোন সুরা কোথায় থাকবে এবং কুরআনের শুরু এবং শেষ কোন সুরাগুলি দিয়ে হবে? অবশ্যই মহানবি (সা.) এই বিষয়ে কোন মতামত দিয়েছিলেন, যে কারণে সকল সাহাবী একমত হতে পেরেছিলেন।

মহানবির (সা.) পরবর্তীতে কুরআনের সংকলন

প্রধান প্রবন্ধ: সাহাবা কর্তৃক কুরআনের সুরাগুলির ক্রমবিন্যাস মহানবির (সা.) পরবর্তীতে কুরআনের সংগ্রহ এবং সংকলনের কাজ সাহাবিদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। সুয়ুতি মনে করেন যে, ইসলামে আলেমগণ এই বিষয়ে একমত।[৩] কথিত যে, প্রথম খলিফা আবু বকরের সময়ে, জায়েদ ইবনে সাবিতের প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো কুরআনের একটি পাণ্ডুলিপি সংকলিত হয়। এর আগে ইমাম আলীও (আ.) একটি পাণ্ডুলিপি সংকলন করেছিলেন। সাহাবিদের অনেকেই কুরআনের সংকলন এবং সংগ্রহের সাথে যুক্ত ছিল। এ কারণেই কুরআনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি সৃষ্টি হয়েছিল যেগুলো হরকত বিশিষ্ট না হওয়ার কারণে ক্বিরাতে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এই পার্থক্য দূর করার জন্য উসমানের সময়ে এসে পাণ্ডুলিপিগুলো এক করে একটি পাণ্ডুলিপি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।[৪]

কুরআনের একক পাণ্ডুলিপি গঠন

মহানবির (সা.) সময়ে ওহি লেখার কাজ সম্পন্ন হয়। তবে যেহেতু ওহির অবতরণ অব্যাহত ছিল, কুরআন একটি একক পাণ্ডুলিপিতে সংকলিত হয়নি। প্রধান ওহি লেখকগণের মধ্যে ছিলেন ইমাম আলী (আ.), উবাই ইবনে কা'ব এবং জায়েদ ইবনে সাবিত। অন্যান্য ওহি লেখকরা ছিলেন পরবর্তীতে অবস্থানে।[৫] অনেকে মক্কার সময়কালে প্রধান ওহি লেখক হিসাবে খোলাফায়ে রাশেদিন, তালহা, যুবাইর ও সা'দ ইবনে আবি ওক্কাস ও অন্যান্য ব্যক্তিদের কথা বলে থাকেন।[৬]

প্রথম খলিফার শাসনামলে, জায়েদ ইবনে সাবিতের মাধ্যমে কুরআনের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা হয়েছিল। ইমাম আলী (আ.) মত বুজুর্গ সাহাবিরাও এই পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের কাজে অংশ নেন এবং যারা হুকুমতের পৃষ্টপোশকতায় বিশেষ অবস্থানে ছিলেন, তাদের পাণ্ডুলিপিগুলো দ্রুত মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।[৭]

কুরআনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির মধ্যে পার্থক্য নিরশস করে তা একত্রিত করা এবং একটি একক পাণ্ডুলিপি ঘোষণা করার মত গুরুত্বপূর্ণ মূল কাজটি হয় উসমানের শাসনামলে। যা মূলত কুরআনের হাফেজ ও লেখকদের একত্রিত করার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। অনেকেই পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতো, যারা যোগ্যতা, সক্ষমতা ও মেধার দিক থেকে এক ছিল না, আর সেজন্যই তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না এবং তাদের প্রত্যেকের সংগ্রহ পদ্ধতি, সূরা ও আয়াতের ক্রমবিন্যাস, পঠন পদ্ধতি (ক্বিরাত) ও অন্যান্য বিষয়ে পার্থক্য ছিল। এই পাণ্ডুলিপি ও পঠনের (ক্বিরাতের) পার্থক্যে, মানুষের মাঝে মতবিরোধের কারণ হত। এজন্য তৃতীয় খলিফা হুযাইফা বিন ইয়ামানের পরামর্শে পাণ্ডুলিপিগুলো সমন্বয়ের কথা ভাবেন। উসমান সাহাবাদের পরামর্শে কুরআনের একক পাণ্ডুলিপি গঠনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয় এবং একটি উবাই ইবনে কা’বের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করার মাধ্যমে কুরআনের একক পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ শুরু করে।[৮]

সুয়ুতি বলেন, ইমাম আলী (আ.) এই বিষয়ে তাঁর নীতিগত সম্মতি প্রকাশ করেছিলেন।[৯] যেহেতু পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে পার্থক্য এবং পাঠ ও উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে কুরআনের আয়াতসমূহে পার্থক্য দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাই তৃতীয় খলিফা পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে উদ্বেগ ও ঝামেলার অবসান ঘটানোর জন্য, একটি একক পাণ্ডুলিপি তৈরি করার পরে অন্যান্য পাণ্ডুলিপিগুলো পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। এই কাজটি উসমানের সমালোচনা ও নিন্দার কারণ হয়।[১০]

সংকলিত কুরআন সম্পর্কে ইমামদের সম্মাতি

মাসুম ইমামগণ মনে করেন, কুরআনকে প্রচলিত পাণ্ডুলিপি ও ক্বিরাত পদ্ধতি অনুযায়ী তিলাওয়াত করা উচিত। যেমন, ইমাম আলী (আ.) খিলাফত গ্রহণের পরে মানুষদেরকে উসমান কর্তৃক সংকলিত পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করতে এবং তাতে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে নিষেধ করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে পরবর্তীতে কেউ কুরআন সংশোধনের নামে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটাতে না পারে।[১১] তদ্রূপ শিয়ারাও তাদের ইমামদের অনুসরণ করার মাধ্যমে মনে করে যে, বর্তমানের কুরআন পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক এবং এতে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটেনি; যেমন, এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এর কাছে কুরআনের একটি আয়াত অন্যদের মতো না পড়ে ভিন্নরূপে তিলাওয়াত করে। ইমাম (আ.) তাকে বলেন: ‍

“এমনভাবে আর কখনো কুরআন তিলাওয়াত করো না বরং যেভাবে সবাই তিলাওয়াত করে, সেভাবেই তিলাওয়াত করো।”.[১২]

অধিক অধ্যয়নের জন্য

  1. তারিখ ও উলুমে কুরআন, মীর মুহাম্মদী জারান্দি।
  2. নেগাহি বে কুরআন, আলী আকবর কোরেইশী।
  3. তারিখে কুরআন, আয়াতুল্লাহ মারেফাত।
  4. উলুমে কুরআন, আয়াতুল্লাহ মারেফাত।

তথ্যসূত্র

  1. যাকযুক, মাহমুদ হামদি, আল-মাউসুয়াতুল কুরআনিয়াতিল মুতাখাস্সেসা, কায়রো- মিশর, ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামি বিষয়ক সর্বোচ্চ পরিষদ, ১৪২৩ হি., পৃ. ২২৪। খুররমশাহী, বাহাউদ্দিন, দানেশনামে কুরআনে কারিম, খ. ১, পৃ. ৪৫৯।
  2. তারিখে তাদভিনে কুরআনে কারীম, সাইয়েদ জাফার মুর্তাজা আমেলি, কেইহান আন্দিশেহ, ১৩৬৮ সৌরবর্ষ, সংখ্যা ২৮।
  3. সুয়ুতি, আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর, আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন, আল হেইয়াতুল মেসরিয়াতুল অম্মাহ লিল কিতাব, ১৩৯৪হি., খ. ১, পৃ. ১৩৫।
  4. জাওয়ান অরাস্তে, হুসাইন, দারসনমে উলুমে কুরআনি, খ. ১, পৃ. ৭।
  5. মারেফাত, মোহাম্মদ হাদী, আত্ তামহীদ ফি উলুমিল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩৩৪-৩৮৫।
  6. দানেশনামে কুরআনে কারিম, বাহাউদ্দিন খুররমশাহী, খ. ১, পৃ. ৪৫৯।
  7. জাওয়ান অরাস্তে, হুসাইন, দারসনমে উলুমে কুরআনি, খ. ১, পৃ. ৭।
  8. মারেফাত, মোহাম্মদ হাদী, আত্ তামহীদ ফি উলুমিল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩৩৪-৩৮৫।
  9. আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন, খ. ১, পৃ. ১২৬।
  10. মারেফাত, মোহাম্মদ হাদী, আত্ তামহীদ ফি উলুমিল কুরআন, খ. ১, পৃ. ৩৩৪-৩৮৫।
  11. পাযুহেশী দার তারিখে কুরআন, পৃ. ৪৪৮-৪৬২।
  12. ওসায়েলুশ শিয়া, শেইখ হুর্রে আমেলি, খ. ৪, পৃ. ৮২১।