আহলে সুন্নতের সূত্রগুলোতে মহানবী (স.)-এর গোসল ও কাফন সম্পন্নকারী
আহলে সুন্নত দাবি করে যে মহানবী (স.)-এর দাফন সংক্রান্ত বিষয়াদির দায়িত্ব ছিল আবু বকরের উপর এবং হযরত আলী (আ.) তীব্র শোকাচ্ছন্নতার কারণে বেহুশ হয়েছিলেন। এই রেওয়ায়েতটি কী সঠিক?
আহলে সুন্নতের গ্রহনযোগ্য সূত্রগুলো মহানবী (স.) গোসল, কাফন, দাফন এবং প্রথম জানাযার নামায আলী (আ.)-এর মাধ্যমে হয়েছে বলে মনে করে এবং অন্য ব্যক্তিরা যেমন, রাসূল (স.)-এর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং তার সন্তান কুসাম ও ফাযল ইমাম আলী (আ.)-কে সহযোগিতা করেছিলেন।
আহলে সুন্নতের পণ্ডিতগণ ও ঐতিহাসিকগণ যেমন, দারুস সীরা ইবনে হিশাম দারুস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ-তে ইবনে হিশাম, দারুত তাবাকাতুল কুবরাতে ইবনে সা’দ, দারুল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-তে ইবনে কাসির, মহানবীর (স.) দাফন ও কাফনের দায়িত্বে আলী (আ.) ছিলেন বলে মনে করেন। এছাড়াও আলী (আ.)-কে যারা এ মর্মে সহযোগিতা করেছেন তাদের নামও উল্লেখ করেছেন। সূত্রগুলোতে, মহানবীর (স.) গোসল সম্পন্নকারী হিসেবে আবু বকরের নাম উল্লেখিত হয় নি।
মহানবী (স.)-এর ওসিয়ত
জামেউল আহাদীস গ্রন্থে সুয়ূতি, একটি রেওয়ায়েতের উল্লেখ করেছেন, উক্ত রেওয়ায়েত অনুসারে, মহানবী (স.) তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে ওসিয়ত করেছিলেন যে আলী (আ.) তাঁর দেহ মোবারককে গোসল দিবেন।[১]
আহলে সুন্নতের সূত্রগূলোতে মহানবীর (স.) গোসল
হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও ওয়াকেদী’র রচয়িতা হিসেবে প্রসিদ্ধ ইবনে সা’দ কিতাবুত তাবাকাতিল কুবরা গ্রন্থে কা’ব আল-আহবার হতে একটি গল্পের বর্ণনা করেছেন। কা’ব আল-আহবার দ্বিতীয় খলিফার নিকট প্রশ্ন করেন যে মহানবী (স.) এহতেযারে (জীবনের শেষ মুহূর্তে) কি বলেছেন? উমর আলীর (আ.) দিকে ইঙ্গিত করেন এবং বলেন, তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করো। আলী (আ.):
- মহানবী (স.) আমার কাঁধে মাথা রাখা অবস্থায় বলছিলেন: আস-সালাত, আস-সালাত (নামায, নামায)…কা’ব: মহানবীকে (স.) কে গোসল দিয়েছিলেন? উমর বললেন আলীর নিকট জিজ্ঞাসা করো এবং আলী (আ.) বললেন আমি মহানবী (স.) গোসল দিয়েছিলাম যখন আব্বাস বসে ছিল এবং মহানবীর (স.) সাহাবী উসামা ইবনে যায়েদ ও মহনবীর (স.) গোলাম শাকরান সালেহ পানি ঢালছিল।[২]
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং মহানবী (স.)-এর সীরাত সম্পর্কে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সংকলনকারী ইবনে হিশাম মহানবী (স.)-এর গোসল দানকারী হিসেবে আলী ইবনে আবি তালিব, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, ফাযল ইবনে আব্বাস, কাসম ইবনে আব্বাস, উসামা ইবনে যায়েদ, শাকরান সালেহ এবং আওস ইবনে খুলী’র (আনসার) নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি মহানবীর (স.)-এর গোসল এরূপ মনে করেন যে, আলী (আ.) মহানবীর (স.) লাশকে নিজের বুকের উপর রেখেছিলেন এবং রাসূলের (স.) চাচা আব্বাস ও তার সন্তান ফাযল ও কুসাম মৃতদেহ নড়াচড়া করানো এবং ডান ও বাম দিকে ঘুরানোর কাজে তাকে সহযোগিতা করছিলেন। আর উসামা ও শাকরান পানি ঢালছিলেন এবং আলী (আ.) মহানবীর (স.) কাপড়ের নীচে ধৌত করছিলেন।[৩] সুয়ূতি কর্তৃক উল্লেখিত একটি রেওয়ায়েত অনুসারে, ফাযল মহানবীর (স.) মৃতদেহ উঁচু করেছিলেন যাতে আলী (আ.) গোসল প্রদান করেন।[৪] এছাড়াও কোন কোন রেওয়ায়েতে, মহানবীর (স.) গোসল দানকারীদের পাশে জিব্রাইলের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[৫]
আহলে সুন্নতের সূত্রগুলোতে মহানবীর (স.) দাফন
ইবনে ইশাম, আলী ইবনে আবি তালিব (আ.), রাসূলের (স.) চাচা আব্বাসের সন্তান ফাযল ও কুসাম এবং গোলাম শাকরানকে মহানবীর (স.) দাফনের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে জ্ঞান করেন যারা রাসূলের (স.) কবরে প্রবেশ করেছিলেন।[৬] উসদুল গাব্বা-তে ইবনে আসীর[৭], দারুল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ইবনে কাসীর[৮] দালায়েলুন নবুওয়াহ-তে বেইহাকি এই বিবরণীর প্রতি ইঙ্গিত করেন যে, আলী (আ.) ও তাঁর সঙ্গীরা ব্যতীত মহানবীর (স.) দাফন কার্যে অংশগ্রহণ করেন নি।[৯]
আহলে সুন্নতের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা তাবারি (মৃত্যু: ৩১০ হি.) তার তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, মহানবীর দাফনের স্থান নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়, কেউ বাকী’র প্রস্তাব দেন, কেউ কেউ বলেন, মসজিদের পাশে এবং কেউ কেউ আবার বলেন, মহানবীর (স.) ঘরে তাঁকে দাফন করি। পরিশেষে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মহানবী (স.) যে রুমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সেখানে মাটি দেওয়া হবে। রাসূল (স.)-এর কবর সাহাবী আবু উবায়দাহ জাররাহ এবং আনসার আবু তালহা আনসারী’র মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয় এবং দাফনের অনুষ্ঠান আলী (আ.) কর্তৃক এবং মহানবীর (স.) চাচা আব্বাস এবং তার সন্তান ফাযল ও কুসামের সহযোগিতায় সম্পাদিত হয়।[১০]
সুন্নিদের কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, মহানবী (স.) হতে আবু বকর কর্তৃক বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত অনুসারে, নবীগণ যে স্থানে ইন্তেকাল করবেন সেখানেই দাফন হবেন, আর তাই মহানবী’র (স.) অন্যতম সাহাবী তালহা মহানবী (স.) যে রুমে দুনিয়া ত্যাগ করেন সেই খানে একটি কবর প্রস্তুত করেন।[৯]তবে তাবরানি একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন যে আলী (আ.) ইবনে আব্বাস ও আবু বকরের সহযোগিতায় মহানবী (স.)-কে দাফন করেন।[১১]
মহানবীর (স.) মৃতদেহের উপর জানাযার নামায আদায়
আহলে সুন্নতের সূত্রগুলো আরও উল্লেখ করেছে; আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি মহানবীর (স.) উপর নামায অনুষ্ঠিত করেন এবং অতপঃর মহানবীর (স.) সাহাবারা দলে দলে তাঁর জানাযার নামায পড়েন। সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বর্ণনা করেন যে, মহানবী (স.) ওসিয়ত করেন তাঁর লাশ তাঁর আহলে বাইতের পুরুষেরা গোসল দিবেন, কাফন কার্য সম্পাদন করবেন এবং তারপর জানাযার নামায আদয় করবেন। অতঃপর জনগণ তাঁর জানাযার নামায পড়বেন এবং পুরুষদের পর নারীরা তাঁর উপর জানাযার নামায পড়বেন।[১২] আহলে সুন্নতের সূত্রগুলোতে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, মহানবীর (স.) লাশের উপর ফুরাদা রূপে নামায পড়া হচ্ছিল এবং প্রত্যেক দলে দশজন করে মহানবীর জানাযায় প্রবেশ করছিল এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করছিল।[১৩] সুন্নি সূত্রগুলোতে এছাড়াও মহানবীর লাশের উপর ফেরেস্তাগণের যেমন জিব্রাইলের নামায পড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[১৪]
তথ্যসূত্র
- ↑ সুয়ুতি, জালাল উদ্দীন (তারিখ অজ্ঞাত), জামেউল আহাদীস, খণ্ড ৩১, স্থান অজ্ঞাত; হাসান আব্বাস যাকি, পৃ. ১৩৫।
- ↑ ইবনে সা’দ, মুহাম্মাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমীয়া, ১৪১০ হি., খণ্ড ২, পৃ. ২০২।
- ↑ ইবনে হিশাম, আব্দুল মালিক, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, বৈরুত, দারুল মা’রিফাহ, তারিখ অজ্ঞাত, খণ্ড ২, পৃ. ৬২২-৬৬৩।
- ↑ সুয়ুতি, জালাল উদ্দীন (তারিখ অজ্ঞাত), জামেউল আহাদীস, খণ্ড ৩১, স্থান অজ্ঞাত; হাসান আব্বাস যাকি, পৃ. ১৩৫।
- ↑ আত-তাবরানি, আবুল কাসিম (১৪১৫)। আল-মু’জামুল কাবির, খণ্ড ৩, কায়রো: মাক্তাবাতু ইবনে তাইমিয়্যাহ, পৃ. ৫৮।
- ↑ ইবনে হিশাম, আব্দুল মালিক, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, বৈরুত, দারুল মা’রিফাহ, তারিখ অজ্ঞাত, খণ্ড ২, পৃ. ৬৬৪।
- ↑ ইবনে আসির জাযরি, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, উসদুল গাবাহ ফি মা’রিফাতিল আসহাবা, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৯ হি., খণ্ড ২, পৃ. ৩৮৮।
- ↑ ইবনে কাসির, ইসমাঈল ইবনে উমর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৭ হি., খণ্ড ৫, পৃ. ২৬৯।
- ↑ বাইহাকি, আহমাদ ইবনে হুসাইন, দালায়েলুন নবুওয়াহ ওয়া মা’রিফাতু আহওয়াল সাহিব আশ-শারীয়াহ, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমীয়া, ১৪০৫ হি., খণ্ড ৭, পৃ. ২৫৪।
- ↑ তাবারি, মুহাম্মাদ ইবনে জারির, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, বৈরুত, মুআসসাসাতুল আ’লামি, তারিখ অজ্ঞাত, খণ্ড ২, পৃ. ৪৫২।
- ↑ আত-তাবরানি, আবুল কাসিম (১৪১৫)। আল-মু’জামুল কাবির, খণ্ড ৩, কায়রো: মাক্তাবাতু ইবনে তাইমিয়্যাহ, পৃ. ৫৮।
- ↑ ইবনে কাসির, ইসমাঈল ইবনে উমর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৭ হি., খণ্ড ৫, পৃ. ২৬৬।
- ↑ মোবারক ফৌরি, সাফিউর রাহমান (১৩৮১)। খুরশিদে নবুওয়াত তরজমায়ে ফার্সি “আর-রাহিকুল মাখতুম” (ভিরাসাতে মুহাম্মাদ আলী লিসানি ফেশারকি), মুওয়াহ্হেদীন, পৃ. ৭৩২-৭৩৫।
- ↑ আত-তাবরানি, আবুল কাসিম (১৪১৫)। আল-মু’জামুল কাবির, খণ্ড ৩, কায়রো: মাক্তাবাতু ইবনে তাইমিয়্যাহ, পৃ. ৫৮।