আহলে বাইত (আ.)-এর সাথে ওয়াহাবীদের শত্রুতা
ইবনে তাইমিয়া ও ওয়াহাবী মতবাদ কি সত্যি সত্যিই আহলে বাইত (আ.)-এর সাথে প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে?
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি ওয়াহাবী মতবাদের শত্রুতা কারও কাছে গোপন নয়। এই শত্রুতা একদিকে যেমন ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া, তেমনিভাবে ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আহলে বাইতের ফজিলতসমূহকে অস্বীকার করা, ইমাম আলী (আ.)-কে ফেরাউনের সাথে তুলনা করা, ইমাম আলীর শত্রুদেরকে নির্দোষ এবং তাঁর অনুসারীদের তাকফির তথা কাফের সাব্যস্ত করা, ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রুদের বিশেষত ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা এবং আহলে বাইতের (আ.) মাজার ধ্বংস করা প্রভৃতি বিষয়গুলো মহানবী’র আহলে বাইতের প্রতি এই সম্প্রদায়টির শত্রুতা পোষণের প্রমাণ বহন করে।
মহানবী’র (স.) আহলে বাইতের (আ.) সাথে ইবনে তায়মিয়ার শত্রুতা
ইবনে তায়মিয়া আহলে বাইতের কোনো ফজিলতকেই স্বীকার করেন না; বরং তিনি আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্বকে আরবের জাহেলিয়াত তথা অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত বলে মনে করেন। ইবনে তায়মিয়া বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতকে অন্যদের চাইতে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম বলে বিশ্বাস করা জাহেলি যুগের চিন্তাধারার অংশ, যে যুগে গোত্রের নেতা ও প্রধানদের অন্যদের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হতো।"[১] ইবনে তায়মিয়ার এই বক্তব্যসমূহ ইসলাম ধর্মের শিক্ষার পরিপন্থী; কারণ যেরূপভাবে কুরআনে আয়াতে তাতহীরে তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বিভিন্ন হাদিসসমূহে বিশেষ করে হাদিসে সাকালাইন ওহাদিসে সাফিনাহ’তে আহলে বাইত (আ.)-এর ফজিলতের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর কুরআনে আয়াতে কুরবা তথা মাওয়াদ্দাতের আয়াতে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা মুসলমানদের উপর ওয়াজীব করা হয়েছে।
ইবনে তায়মিয়া ইমাম আলী (আ.)-কে রক্তপাত ও ক্ষমতা লোভের ক্ষেত্রে ফেরাউনের সাথে তুলনা করেন। অথচ শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের সূত্রগুলোতে একটি বর্ণিত হয়েছে যে, আলী, ফাতিমা,হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে মহানবী (স.) বলেছেন: অর্থাৎ «انا حرب لمن حاربتم و سلم لمن سالمتم؛ তোমরা যার সাথে যুদ্ধ করবে, আমিও তার সাথে যুদ্ধ করব; আর তোমরা যার সাথে সন্ধি ও আপোষ করবে, আমিও তার সাথে সন্ধি ও আপোষ করবো।»[২] জাসসাস এই হাদিসটি উল্লেখ করার পর বলেন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হবে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে, এমনকি সে যদি মুশরিকও না হয়।[৩]
এই হাদিস এবং অন্যান্য অগণিত হাদিস ও ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইবনে তায়মিয়া ও ওয়াহাবীদের এরূপ বিশ্বাস ও অবস্থান এটি নিশ্চিত করে যে, ইবনে তায়মিয়া এবং তার অনুসারীদের শত্রুতা কেবল আহলে বাইতের প্রতিই নয়, বরং তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা থেকে উদ্ভূত। আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং তাঁর সঙ্গীদের সম্পর্কে ইবনে তায়মিয়া এমন কিছু কথা বলেছেন যা ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি তাঁর প্রকাশ্য শত্রুতার বিষয়টি প্রমাণ করে। তিনি বলেন:
- "খারেজি, উমাইয়া এবং মারওয়ানিদের ন্যায় যারা আলীকে গালি দিয়েছে, তাকে লানত করেছে এবং তাকে কাফির ও জালিম বলে ঘোষণা করেছে, তারা সবাই ইসলামের অনুসারী ছিল এবং ইসলামী আচার-আচরণ মেনে চলতো। কিন্তু আলীকে যারা নিষ্পাপ জ্ঞান করেন এবং যারা তাঁর অনুসারী, তারা সকলেই মুরতাদ ও কাফের।"[৪]
অথচ ইমাম আলী (আ.) হচ্ছেন পবিত্র আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও আহলে সুন্নতের প্রখ্যাত মুফাসসির ফাখরে রাযী বলেন: "যে ব্যক্তি তার ধর্মের ক্ষেত্রে আলী ইবনে আবি তালিবকে অনুসরণ করবে, নিশ্চয় সে হেদায়েতপ্রাপ্ত।" আর এর প্রমাণ হলো মহানবী (স.) এর উক্তি: «اللهم ادر الحق مع علی حیث دار»[৫] এছাড়াও আহলে সুন্নতের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, আলী সত্যের সাথে এবং সত্য আলীর সাথে রয়েছে, যেখানেই হোক না কেন।[৬]
ইবনে তায়মিয়া আহলে বাইতের ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত সকল হাদিসকে হয় সনদগতভাবে বিতর্কিত বলে উল্লেখ করেন অথবা হাদীসগুলোর দলিলকে প্রত্যাখ্যাত হিসেবে গণ্য করেন। উদাহরণস্বরূপ, আহলে সুন্নতের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থসমূহে যেমন সহীহ মুসলিমে আয়াতে তাতহীরের শানে নুযুলে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা’র বর্ণনা এবং অপর একটি বর্ণনায় উম্মে সালমা থেকে উল্লেখিত হয়েছে যে, এই আয়াত (আয়াতে তাতহীর) নাযিল অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন: "হে আল্লাহ! এরাই হচ্ছে আমার আহলে বাইত; এদের থেকে সকল প্রকারের অপবিত্রতা দূর করুন এবং এদেরকে পবিত্র করুন।"[৭] ইবনে তায়মিয়া এই হাদিসের সনদে কোনো খুঁত খুঁজে না পেয়েও আহলে বাইত সম্পর্কে অবতীর্ণ হওয়া এই আয়াত সম্পর্কে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেন, না এই আয়াত আহলে বাইত সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, আর না আহলে বাইত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স.) এর দোয়া আহলে বাইতের কোনো সদস্যের মর্যাদা বা ফজিলত প্রমাণ করে।[৮]
ইবনে তায়মিয়ার এই ধরনের বক্তব্য আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতার প্রমাণ। অথচ আহলে বাইতের মর্যাদা, কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অংশ, যা ইবনে তায়মিয়ার মতো ব্যক্তিদের বক্তব্য দ্বারা উপেক্ষা করা যায় না।
ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে বর্তমান কালের ওয়াহাবী মুফতি আব্দুল আজিজ আল শাইখের দৃষ্টিভঙ্গি
ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে বর্তমান কালের ওয়াহাবী মুফতি আব্দুল আজিজ আল-শাইখের দৃষ্টিভঙ্গি ইবনে তায়মিয়া ও অন্যান্য প্রাক্তন ওয়াহাবী নেতাদের চেয়েও বেশি চরমপন্থী ও নেতিবাচক। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ওয়াহাবী মতাদর্শের সর্বোচ্চ মুফতি আল-শাইখ, ওয়াহাবীদের হৃদয়ের কথাটির উন্মোচন করেছেন এবং অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও খোলাখুলিভাবে ইয়াজিদকে সঠিক ও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ভ্রান্ত বলে দাবি করেছেন।
সৌদি আরবের "আল-মাজদ" স্যাটেলাইট চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে এক মহিলার প্রশ্নের জবাবে ইয়াজিদ ও ইমাম হুসাইন (আ.)- এর ক্বিয়াম তথা বিদ্রোহ সম্পর্কে আল-শাইখ যা বলেছেন, তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে- ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) একটি শরীয়তসম্মত বাইয়াত যা তার পিতা মুয়াবিয়ার সময়ে জনগণের নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং মানুষ তাতে সম্মতী প্রদান করেছিল। কিন্তু যখন মুয়াবিয়া মৃত্যুবরণ করেন, তখন হুসাইন ইবনে আলী ও ইবনে যুবায়ের ইয়াজিদের নিকট বাইয়াত করতে অস্বীকার করেন। ফলে হুসাইন ও ইবনে যুবায়ের বাইয়াত না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেছেন। আর হুসাইন অন্যের উপদেশের প্রতি কর্ণপাত করেন নি এবং কল্যাণের বিপরীত কাজ করেছেন, আর আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছিলেন, তাই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, "হুসাইন যে ভুল করুক না কেন, তা তার নিজের জন্যই করেছেন!!... যাই হোক, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হুসাইনের ক্বিয়াম ও বিদ্রোহ হারাম ছিল!!... এ কাজ না করাই ছিল তার জন্য উত্তম। মদীনায় থাকা এবং মানুষের সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলাই উত্তম ও বেশি উপযুক্ত ছিল। খিলাফতের সীমানা লঙ্ঘন করা জায়েজ ছিল না। তবে, এতদ্বসত্ত্বেও আমরা হুসাইনের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করি এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি!!"[৯]
সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদিস অনুযায়ী, ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার ভাই ইমাম হাসান (আ.) যখন জান্নাতের যুবক দের সর্দার তখন তাদের সম্পর্কে ভুল বা গুনাহর কথা কল্পনা করাও অসম্ভব। তাহলে, কেন আল-শাইখ বা অন্য ব্যক্তিদেরকে তাঁর জন্য ক্ষমা চাইতে হবে!
আশুরা দিবস সম্পর্কে ওয়াহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি
সাম্প্রতিক কালের ওয়াহাবীরা আশুরার দিনকে আনন্দের দিন হিসেবে বিবেচনা করে। কুয়েতের ওয়াহাবীরা তাদের কিছু কিছু প্রকাশনায় হুসাইনের আশুরাকে আনন্দ ও উৎসবের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও,আহলে সুন্নত কর্তৃক রাসূল (স.)-এর পরিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সত্ত্বেও, ওয়াহাবীরা ইচ্ছাকৃতভাবে কুয়েতে তাসুয়া ও আশুরার রাতে তাদের বিবাহ ও উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।[১০]
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আহলে বাইতের প্রতি, বিশেষ করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি তীব্র শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারী আল-শাইখ, তার এই শত্রুতা প্রকাশের জন্ তার পুত্র উমর ইবনে আব্দুল আজিজের বিয়ের অনুষ্ঠান আশুরার দিনে আয়োজন করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে সৌদি আরবের অনেক মুফতি অংশগ্রহণ করেছিলেন।[১১]
হযরত যায়নাব (সা. আ.)-এর মাজার যিয়ারতের প্রতি ওয়াহাবীদের বিদ্বেষ
সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা’র অর্থায়নে পরিচালিত ওয়াহাবী সংবাদ নেটওয়ার্ক "সাফা", যার প্রধান কার্যালয় কুয়েত, কায়রো ও রিয়াদে অবস্থিত, ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সদস্যদেরকে শামে বনি উমাইয়ার বংশধর বলে হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের উদ্দেশ্যে বলেছে:
- "হে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের বংশধর! হে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার বংশধর! হে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সৈন্যরা! তোমাদের অবশ্যই যায়নাবের কবরকে (মাজার)লক্ষ্যবস্তু করে তা ধ্বংস করতে হবে এবং একইভাবে অন্যান্য সব মাজারও ধ্বংস করতে হবে।"[১২]
সমসাময়িক ওয়াহাবীরা এই পথে এতটাই চরমপন্থার দিকে এগিয়েছে যে, তারা ইয়াজিদ ও ইবনে জিয়াদের নামে একটি সেনাদল গঠন করেছে এবং "ইয়াজিদ ও ইবনে জিয়াদ শহীদ হয়েছেন" এই স্লোগান ব্যবহার করে পাকিস্তানে মিছিল বের করছে।[১৩]
আহলে বাইতের শত্রুদের প্রতি ওয়াহাবীদের সমর্থন
ওয়াহাবীরা, রাসূলুল্লাহ’র (স.) আহলে বাইতের সাথে তাদের শত্রুতা প্রকাশ করতে গিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হত্যাকারীদের প্রতি সমর্থনের উপর গুরুত্বারোপ করে তাদেরকে দৃঢ়চিত্তে রক্ষা করছে।
- ইবনে তাইমিয়া তার গ্রন্থ "মিনহাজুস সুন্নাহ"-এর চতুর্থ খণ্ডে (৫৪৯-৫৭৫ পৃষ্ঠা) ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে মুসলমানদের অন্যান্য খলিফাদের মাকামের সমপর্যায়ে স্থান দিয়েছেন এবং কারবালার মর্মান্তিক ঘটনায় ইয়াজিদকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, যে ঘটনায় রাসূলুল্লাহর (স.) প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী (আ.), তাঁর সন্তানগণ ও সঙ্গী-সাথীরা শহীদ হন এবং রাসূলের (স.) পবিত্র আহলে বাইত বন্দী হন।
- তিনি বলেন: "ধরে নেওয়া যাক যে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ফাসেক ও জালিম ছিলেন, তবে আল্লাহ তাকে তার কিছু ভালো কাজের জন্য ক্ষমা করবেন!"[১৪] এছাড়াও, তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামী উমর ইবনে সাদের পক্ষে সরাসরি সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেন: "সত্য যে, উমর ইবনে সাদ সেনাপতি ছিলেন এবং ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যা করেছিলেন, তবে তার পাপ ও অপরাধ ‘মুক্তার ইবনে আবি উবাইদা’র চেয়ে কম, বরং মুক্তারের পাপ ও অপরাধ উমর ইবনে সাদের চেয়েও বড়!"[১৫]
- ওয়াহাবীরা, আহলে বাইতের শত্রুদের প্রশংসায় বিশেষ করে আলী (আ.)-এর অন্যতম শত্রু মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান এবং তার পুত্র ইয়াজিদের প্রশংসায় "ফাযায়েলে মুয়াবিয়া ওয়া ফি ইয়াজিদ ওয়া আনাহু লা ইয়াসিব" নামে বই রচনা করেছেন। যারা মুয়াবিয়ার প্রশংসা করতে চায়, নাসাঈ তাদের জবাবে বলেন, রাসূল (স.)-এর পক্ষ থেকে মুয়াবিয়ার প্রতি বিখ্যাত অভিশাপ ব্যতীত তার সম্পর্কে কোনো ফজিলত আমার জানা নেই, যেখানে তিনি (স.) বলেছেন: «لا أشبع الله بطنه» (আল্লাহ তার পেট যেন কখনো পরিপূর্ণ না হয়)।[১৬]
- ওয়াহাবী বা সালাফি পণ্ডিতরা, যেসব রেওয়ায়েতসমূহে আহলে বাইতের বিরোধীদের যেমন মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান, উমর ইবনে সাদ, বনি উমাইয়া, বনি মারওয়ান, আমর ইবনে আল-আস, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া এবং অন্যান্যদের সম্পর্কে নিন্দা ও সমালোচনা করা হয়েছে, সেগুলিকে কোনো প্রমাণ বা যুক্তি ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, এই ধরনের রেওয়ায়েতগুলোর সবই মিথ্যা ও বানোয়াট।[১৭]
- সমসাময়িক ওয়াহাবী মতবাদে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তার গুরুত্ব এতটাই যে, সৌদি আরবের শিক্ষা মন্ত্রণালয় "হাকাইক হাক্বায়েক্ব আন আমির আল-মুমিনিন ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া" শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেছে এবং বইটিকে সে দেশের সরকারি স্কুলগুলিতে পাঠ্য পুস্তক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।[১৮]
- ইরাকের একটি মিডিয়া একটি চিত্র প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যায় যে, সৌদি আরবের ওয়াহাবী শাসকরা, মহানবী (স.) এবং তাঁর প্রিয় আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতি তাদের গভীর বিদ্বেষের নিদর্শন স্বরূপ আল্লাহর শেষ রাসূল (সা.) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শত্রুদের নাম স্কুল, রাস্তা এবং অন্যান্য স্থানের নামকরণ করেছে। যেমন: ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া স্কুল, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া সড়ক, আবু লাহাব স্কুল (যে আবু লাহাবের বিরুদ্ধে আল্লাহ কুরআনে সম্পূর্ণ একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন) এবং আবরাহা আল-হাবশির নামে রাস্তা (যে ব্যক্তি আমলফীলে কাবা ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল এবং আল্লাহ তাকে ও তার সৈন্যদের ভয়াবহ শাস্তি দিয়েছিলেন)।[১৯]
আহলে বাইতের (আ.) কবর ধ্বংস
ওয়াহীরা বাকি কবরস্থানে আহলে বাইতের কবরসমূহ ধ্বংস করে, কারবালা ও নাজাফে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে ইমাম হুসাইন ও ইমাম আলী (আ.) এর মাজার ধ্বংস করে এবং আহলে বাইত প্রেমিক মুসলমানদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে আহলে বাইতের (আ.) প্রতি তাদের শত্রুতা ও বিদ্বেষের বিষয়টি প্রমাণ করেছে।
আর তাদের এহেন কর্মকাণ্ড, রাসূলুল্লাহ (স.) এর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা এবং আহলে বাইতের শত্রুদের বিশেষ করে ইয়াজিদ ও তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তাদের বিকৃত ও বিচ্যুত চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত। সৌদ ইবনে আবদুল আজিজের নেতৃত্বে ১২১৬ থেকে ১২২৫ হিজরি অবধি কারবালা ও নাজাফের দিকে তাদের ধারাবাহিক সামরিক অভিযানের কারণ হিসেবে আহলে বাইতের প্রতি ওয়াহাবীদের শত্রুতা ব্যতীত অন্য কী ব্যাখ্যা দিবে?
১২৬২ হিজরীতে নাজদ ও আশেপাশের বেদুইন গোত্র, হেজাজ ও তিহামার অধিবাসীদের সমন্বয়ে গঠিত ওয়াহাবী বাহিনী, জিলকদ মাসে কারবালায় প্রবেশ করে। তারা শহরের রাস্তাঘাট, বাজার ও বাড়িতে ঢুকে অধিকাংশ লোককে হত্যা করে। অতঃপর তারা প্রচুর ধন-সম্পদ লুট করে শহর ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তীতে তারা "আবিয়াদ" নামক এলাকায় জড়ো হয় এবং লুটকৃত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) সৌদ ইবনে আবদুল আজিজ নিজের জন্য রেখে বাকি অংশ সৈনিকদের মধ্যে, প্রতি পদাতিক সৈনিককে এক ভাগ করে এবং প্রতিটি অশ্বারোহী সৈনিককে দুই ভাগ করে বণ্টন করে দেওয়া হয়।[২০]
তথ্যসূত্র
- ↑ ইবন তাইমিয়াহ, আহমদ বিন আবদুল হালিম, মিনহাজুস সুন্নাহ, মিসর, মুয়াসসাসাতু কুরতুবা, খ: ৩, পৃ: ২৬৯।
- ↑ হাকিম নিশাপুরী, মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ, আল-মুস্তাদরাক আলাস সহিহাইন, বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, চ: ১, ১৪১১ হি./১৯৯০ ম., গবেষণা: মুস্তাফা আবদুল কাদির আতা, খ: ৩, পৃ: ১৬১; সুনান ইবন মাজাহ, মোহাম্মদ বিন ইয়াজিদ আবু আবদুল্লাহ আল-কুজুইনি, সুনান ইবন মাজাহ, দারুল ফিকর - বৈরুত, গবেষণা: মোহাম্মদ ফুয়াদ আবদুল বাকী, পৃ: ৫২।
- ↑ জাসস, আহমদ বিন আলী আর-রাজী, আহকামুল কুরআন লিল জাসস, বৈরুত, দার ইহিয়াউত্তুরাস আল-আরাবি, ১৪০৫ হি., গবেষণা: মোহাম্মদ আস-সাদিক কামাহাউই, খ: ৪, পৃ: ৫১।
- ↑ ইবন তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ, খ: ৫, পৃ: ৯।
- ↑ ফখরুর রাজী, ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ বিন ওমর আত-তামীমি আর-রাজী আশ-শাফেয়ি, আত-তাফসিরুল কবির অথবা মাফাতিহুল গাইব, বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, চ: ১, ১৪২১ হি./২০০০ ম., খ: ১, পৃ: ১৬৮
- ↑ হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাস সহিহাইন, খ: ৩, পৃ: ১৩৪; হাইসামি, নূরুদ্দিন আলী বিন আবু বকর, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, কায়রো, দারুর রিয়ান লিত্তুরাস, বৈরুত, দারুল মাকতাব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৪০৮ হি., খ: ৭, পৃ: ২৩৫।
- ↑ আহমদ বিন হাম্বল, মুসনাদ আহমদ, বৈরুত, দারুস সাদির, বি-তা, খ: ১, পৃ: ৩৩১।
- ↑ ইবন তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ, মাটবাআতুল কুবরা আল-আমিরিয়্যাহ, চ: ১, ১৩২২ হি., খ: ৩, পৃ: ৪।
- ↑ http://database-aryana-encyclopaedia.blogspot.com/২০১৩/۰۷/blog-post_14.html
- ↑ খবরনামা, সংখ্যা ১১৫৩, পৃ: ৫৩।
- ↑ সাইট: মাশরিক নিউজ।
- ↑ খবরনামা জামেয়া মুদাররিসিন, সংখ্যা ১১৩৮, পৃ: ৫৬।
- ↑ খবরনামা জামেয়া মুদাররিসিন, সংখ্যা ১১৯৫, পৃ: ৫১।
- ↑ ইবন তাইমিয়াহ, আহমদ বিন আবদুল হালিম, মাজমুউল ফাতাওয়া, বি-তা, বি-জা, খ: ৩, পৃ: ৪১৩; খ: ৪, পৃ: ৪৭৫।
- ↑ মিনহাজুস সুন্নাহ, খ: ২, পৃ: ৭০।
- ↑ আন-নাসাঈ, আহমদ বিন শুয়াইব, খাসায়িস ইমামুল মু’মিনিন (আ.), মাকতাবাতুন নিনাওয়ী আল-হাদিসাহ, পৃ: ২৩; আবু দাউদ, সুলাইমান, মুসনাদ আবু দাউদ, বৈরুত, দারুল হাদিস, পৃ: ৩৫৯।
- ↑ ইবনুল কাইয়্যিম, মোহাম্মদ বিন আবু বকর, নাকদুল মানকুল, বৈরুত, দারুল ক্বারী, চ: ১, ১৪১১ হি., পৃ: ১০৮।
- ↑ তিজানী, সাইয়্যেদ মোহাম্মদ, আশ-শিয়াহ হুম আহলুস সুন্নাহ, পাদটীকা পৃ: ৯৪; আসআদ ওয়াহিদ আল-কাসিম, হাকিকাতুশ শিয়াহ আল-ইসনা আশারিয়্যাহ, পৃ: ৮২।
- ↑ খবরনামা জামেয়া মুদাররিসিন, সংখ্যা ১১৯৮, পৃ: ৬৫।
- ↑ সালেহ আল-উথাইমিন, আব্দুল্লাহ, তারিখুল মামলাকাতিস সৌদিয়্যাহ, রিয়াদ, উবাইকান, চ: ১৫, ১৪৩০ হি., খ: ১, পৃ: ৭৩।