ইমাম হুসাইন (আ.) এবং ইমাম হাসান (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিঠে আরোহী
ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে মহানবি (স.) কর্তৃক বর্ণিত «نعم الجمل جملکما و نعم العدلان انتما» হাদীসটির অর্থ ও উৎস কী?
রাসূল (স.)-এর পিঠে ইমাম হুসাইনের (আ.) এবং ইমাম হাসান (আ.) আরোহণ সংক্রান্ত রেওয়েতটি মহানবি (স.) হতে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত যা বিভিন্ন টেক্স আকারে শিয়া ও সুন্নি গ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে। উক্ত রেওয়ায়েতের বিষয়বস্তুর মাধ্যমে আল্লাহর রাসূলের (স.) তাঁর দৌহিত্র ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইন (আ.) এর প্রতি অত্যধিক ভালবাসার বিষয়টি বুঝানো হয়েছে।
উক্ত রেওয়ায়েতটির শিয়া রাভীগণের (হাদিস বর্ণনাকারী) ক্ষেত্রে মানাকেব গ্রন্থে ইবনে শাহরে আশুব এবং কাশফুল ইয়াকীন গ্রন্থে আল্লামা হিল্লির প্রতি ইঙ্গিত করা যেতে পারে। এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করার সবচেয়ে মূল মাধ্যম ও রুট হচ্ছে সুফিয়ান সূরি হতে ও তিনি জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে এবং জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হযরত রাসূল (স.) হতে বর্ণনা করেছেন।
রেওয়ায়েতের মূল টেক্সট
আলোচ্য রেওয়ায়েতটি শিয়া ও আহলে সুন্নতের হাদিস ও ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে। হাদিসের টেক্সটি নিম্নরূপ:
«عن جابر بن عبدالله قال: دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيِّ وَ الْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ عَلَى ظَهْرِهِ وَ هُوَ يَجْثُو بِهِمَا وَ يَقُولُ نِعْمَ الْجَمَلُ جَمَلُكُمَا وَ نِعْمَ الْعَدْلَانِ أَنْتُمَا.؛ জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেন, মহানবি (স.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, তিনি (স.) চার হাত ও পায়ের উপর ভর দিয়ে (হামাগুড়ি) হাঁটছেন এবং ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.) রাসূলুল্লাহর পিঠের উপর সওয়ার ছিলেন। মহানবি (স.) তাঁদের দু’জনের জন্য নীচু হচ্ছিলেন এবং বলছিলেন: তোমাদের উটটি কতই না সুন্দর একটি উট এবং তোমরা কতই না সুন্দর আরোহী।»
সূত্রসমূহ ও বর্ণনাকারীগণ
এই রেওয়ায়েত বিভিন্ন শব্দ আকারে এবং একই ধরনের অর্থে আহলে সুন্নতের কিছু সংখ্যক উৎসসমূহে বর্ণিত হয়েছে; যেমন:
- শাফেয়ী মাযহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও রিজালশাস্ত্রবিদ ইবনে আদি জারজানি (২৭৭ থেকে ৩৬৫ হি.), আল-কামিল ফি যোআফায়ির রিজাল গ্রন্থে এই রেওয়ায়েতটির উল্লেখ করেছেন।[১]
- হাম্বালি মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ, মুহাদ্দিস ও কালামশাস্ত্রবিদ ইবনে বাত্তাহ উকবারি (৩০৪ থেকে ৩৮৭ হি.), এই রেওয়ায়েতটিকে আল-ইবানাতুস সোগরা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[২]
- শাফেয়ী মাযহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দেস ও সুফি হিসেবে পরিচিত আবু সা’দ খারগুশি (মৃত্যু ৪০৬ বা ৪০৭ হি.) শারফুন নবি গ্রন্থ এই বিষয় সম্পর্কে দুটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।[৩]
- আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ ইবনে আসাকির (৪৯৯ থেকে ৫৭১) তারিখে দামেস্ক গ্রন্থে এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।[৪]
- আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও রিজালশাস্ত্রবিদ যাহাবি (৬৭৩ থেকে ৭৪৮) সিয়ার আ’লামুন নুবালা[৫] এবং মিযানুল এ’তেদাল নামক দুটি গ্রন্থে উক্ত রেওয়াতটির উল্লেখ করেছেন এবং দ্বিতীয় গ্রন্থে এটিকে সহীহ নয় বলে বিবেচনা করেছেন।[৬]
এই রেওয়ায়েতটি শিয়া সূত্রগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দরূপে তবে অনুরূপ অর্থে উল্লেখিত হয়েছে। সূত্রগুলোতে এই রেওয়ায়েতটি আহলে সুন্নতের গ্রন্থগুলো হতে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন:
- শিয়া মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবনে শাহরে আশুব (৪৮৮ থেকে ৫৮৮ হি.), তাঁর মানাকেব গ্রন্থে এই রেওয়ায়েতটিকে আহলে সুন্নতের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন।[৭]
- বিশিষ্ট শিয়া মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবিদ ইরবিলি (মৃত্যু: ৬৯২ হি.) তার কাশফুল গুম্মাহ নামক গ্রন্থে রেওয়াটি বর্ণনা করেছেন।[৮]
- শিয়া মাযহাবের বিশিষ্ট পণ্ডিত আল্লামা হিল্লি (৬৪৮ থেকে ৭২৬) এই রেওয়ায়েতটিকে তার কাশফুল ইয়াকিন গ্রন্থে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারি’র উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন।[৯]
- আল্লামা মাজলিসী (১০৩৭ থেকে ১১১০) এই রেওয়ায়েতটিকে বিভিন্ন রূপে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[১০] এই হাদিস বিভিন্ন মাধ্যম ও ভায়া হয়ে বিশিষ্ট সুফি ফকীহ ও মুহাদ্দিস সুফিয়ান সূরি (৯৭ থেকে ১৬১ হি.) হতে, তিনি আবি যুবাইর হতে এবং আবি যুবাইর রাসূলুল্লাহ (স.) বিখ্যাত সাহাবি জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারি হতে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অপর একটি রুটে উক্ত রেওয়ায়েতটি উমর ইবনে খাত্তাব হতে বর্ণিত হয়েছে।[১১]
তথ্যসূত্র
- ↑ ইবনে আসাকির, আবদুল্লাহ ইবনে আদি জুরজানি, আল-কামিল ফি দুআফা আর-রিজাল, তাহকিক সুহাইল জাকার, ইয়াহিয়া মুখতার গাজাওয়ি, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৯ হিজরি, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৫৯।
- ↑ ইবনে শাহর আশুব, মুহাম্মদ ইবনে আলী, মানাকিব আল আবি তালিব, তাহকিক মুহাম্মদ হোসাইন আশতিয়ানি, সাইয়িদ হাশিম রাসুলি মাহালাতি, কুম, আল্লামা, ১৩৭৯ হিজরি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৮৭।
- ↑ খারগুশি, আবু সাঈদ আবদুল মালিক ইবনে মুহাম্মদ, মানাহিল আশ-শিফা ওয়া মানাহিল আস-সাফা বিহকিক কিতাব শারাফ আল-মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, রিওয়ায়াত আবদুল করিম ইবনে হাওয়াযিন কুশাইরি, মক্কা, দারুল বাশায়ির আল-ইসলামিয়া, ১৪২৪ হিজরি, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৯৫।
- ↑ ইবনে আসাকির, আলী ইবনে হাসান, তারিখ মাদিনাত দিমাশ্ক, তাহকিক আলী শিরি, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪১৫ হিজরি, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ২১৭।
- ↑ যাহাবি, শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ, সিয়ার আ'লাম আন-নুবালা, তাহকিক মাজমুআতুন মিন আল-মুহাক্কিকিন বিইশরাফ শুআইব আল-আরনাউত, মুআসসাসাতুর রিসালা, ১৪০৫ হিজরি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৫৬।
- ↑ যাহাবি, শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ, মিযানুল ই'তিদাল ফি নাকদ আর-রিজাল, তাহকিক আলী মুহাম্মদ আল-বাজাওয়ি, বৈরুত, দারুল মা'রিফা লিত-তিবাআ ওয়ান-নাশর, ১৩৮২ হিজরি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯৭।
- ↑ ইবনে শাহর আশুব, মানাকিব আল আবি তালিব, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৮৭।
- ↑ আরবিলি, আলী ইবনে ঈসা, কাশফুল গুম্মা ফি মা'রিফাতিল আইম্মা (প্রাচীন সংস্করণ), তাহকিক সাইয়িদ হাশিম রাসুলি মাহালাতি, তাবরিজ, বনি হাশিমি, ১৩৮১ হিজরি।
- ↑ আল্লামা হিলি, হাসান ইবনে ইউসুফ, কাশফুল ইয়াকিন ফি ফাদাইল আমিরুল মুমিনিন, তেহরান, ওয়াজারাতুস সাকাফা ওয়াল ইরশাদ আল-ইসলামি, মুআসসাসাতুত তিবাআ ওয়ান-নাশর, ১৪১১ হিজরি, পৃষ্ঠা ৩০৭।
- ↑ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির ইবনে মুহাম্মদ তাকি, বিহারুল আনোয়ার আল-জামিয়া লিদুরার আখবার আল-আইম্মাতুল আতহার, বৈরুত, দার ইহইয়াউত তুরাস আল-আরাবি, ১৪০৩ হিজরি, খণ্ড ৪৩, পৃষ্ঠা ২৮৫-২৮৬।
- ↑ মাজলিসি, বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড ৪৩, পৃষ্ঠা ২৮৫।