জায়নবাদী ধারণার সৃষ্টি

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

জায়নবাদী ধারণা কীভাবে গঠন হলো?

বিশ্বের ইহুদিদের ছত্রভঙ্গ হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্যই মূলত জায়নবাদের ধারণার সৃষ্টি হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠন এবং বিশ্বের সমস্ত ইহুদিদের সেখানে একত্রিত করা। বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইউরোপে ইহুদিদের উপর সৃষ্ট চাপই মূলত ইহুদিদের সংগঠনের প্রেরণাকে আরও জোরদার করে। অস্ট্রিয়ার ইহুদি লেখক ‍“থিওডর হার্জল” -এর ধারণা, একটি স্বাধীন ইহুদি ভূখণ্ড গঠনের লক্ষ্যে জায়নবাদী ধারণা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। তিনি ১৮৯৫ সালে ‍“দ্য জুইশ স্টেট” নামে একটি বইয়ে এই ধারণাটি লিখেন এবং প্রকাশ করেন।

জায়নবাদের প্রকৃতি

জায়নবাদ হলো ইহুদি জাতির একটি আন্দোলন, যাদের লক্ষ্য ফিলিস্তিনে একটি স্বায়ত্তশাসিত ইহুদি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই আন্দোলনের নামটি জেরুজালেমের জায়ন পর্বত (দাউদ নবির সমাধিস্থল) থেকে উদ্ভূত হয়েছে।[১] এই আন্দোলনের পথপ্রদর্শকেরা জাতিগত বৈষম্য এবং ইহুদিদের আধিপত্যের ভিত্তিতে তাদেরকে ফিলিস্তিনে আগমনের জন্য আহ্বান জানায় এবং "ফিলিস্তিন হল প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতার পুণ্যভূমি" শ্লোগানের ভিত্তিতে সেখানে তাদের বসতি স্থাপন করে। এই ধারণা বাস্তবায়নের জন্য তারা ফিলিস্তিনের আদি অধিবাসী অর্থাৎ মুসলিম ও খ্রিষ্টান আরবদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং তাদেরকে হিংস্রভাবে বিতাড়িত বা হত্যা করার মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের একটি বিরাট অংশ দখলে নিয়ে নেয়।[২]

জায়নবাদ একটি রাজনৈতিক সংগঠন, যারা সহিংসতার মাধ্যমে ফিলিস্তিন এবং তার আশেপাশের আরব দেশগুলোতে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বের সকল ইহুদিদেরকে সেই রাষ্ট্রে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।[৩]

উৎপত্তির পটভূমি

শুরুতে সংগঠনটির ফিলিস্তিনে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা উদ্দেশ্য ছিল না, বরং তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের ছত্রভঙ্গ হওয়া থেকে রক্ষা করা। এই প্রাথমিক ধারণা থেকেই মূলত এই আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটে।[৪]

রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়ার মতো বিভিন্ন পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে ইহুদিদের উপর চাপ সৃষ্টি, ইহুদিদের সংগঠনের অনুপ্রেরণাকে আরও শক্তিশালী করে। এ প্রসঙ্গে পিঙ্কার নামক এক ইহুদি নেতা ‌‘স্বায়ত্তশাসন’ নামে একটি বই লেখেন, যা ইহুদিদের সংগঠনকে পূর্বের চাইতে আরও অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। এই বইয়ে তিনি লেখেন,

“বিশ্ব ইহুদিদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে, কারণ পুরো পৃথিবীতে আমাদের কোনও স্বদেশ, কেন্দ্র বা স্বাধীনতা নেই, এবং আমরা সর্বত্র বিদেশি হিসাবে বিবেচিত হই এবং এই কষ্টের প্রধান প্রতিকার হচ্ছে সারাবিশ্বের ইহুদিরা তাদের মাতৃভূমিতে (ফিলিস্তিন) একত্রিত হওয়া এবং একটি স্বাধীন ইহুদি জাতি গঠন করা। ...”

এই প্রস্তাবের সূত্রধরে ‍‘জায়নবাদ প্রেমিক’ সমাজ তৈরি হয়, যারা নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যগুলো অনুসরণ করে:

  1. হিব্রু ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
  2. ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে অভিবাসনে আমন্ত্রণ জানানো ও উৎসাহিত করা।#ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অধিগ্রহণ ও বসবাসের বন্দোবস্ত করা।[৫]

এই সংগঠনটির অর্থায়ন হত বিত্তশালী ইহুদি ব্যারন এডমন্ড রথসচাইল্ড -এর মত ইহুদি পুঁজিপতিদের মাধ্যমে, যা দিয়ে তারা ফিলিস্তিনে কয়েকটি ছোট জমি অর্জন করতে এবং সেখানে ইহুদিদের বসতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ‌‘জায়নবাদ প্রেমিক’ আন্দোলনটি শুরুতে উল্লেখযোগ্য কোনও আন্দোলন ছিল না এবং এর কোনও সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল না; পরে অস্ট্রিয়ার ইহুদি লেখক থিওডর হার্জল, এক ইহুদির সাথে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং একটি স্বাধীন ইহুদি ভূখণ্ড তৈরির উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ১৮৯৫ সালে তিনি ‌‘দ্য জুইশ স্টেট’ নামে একটি বই লেখেন ও প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি তার ধারণা সম্পর্কে লেখেন,

“ইহুদিদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে, যাদের নিজ দেশের দুঃখকষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই, তারা যেন একটি বৃহৎ জাতির জন্য যথেষ্ট হয় এমন এক বিশাল অঞ্চলে সমবেত হয়।”

হার্জলের বই এবং জায়নবাদী রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে তার প্রদত্ত ধারণার প্রতি ইহুদিদের তীব্র অভ্যর্থনা, জায়নবাদের সমর্থকদেরকে বিশেষ করে হার্জলকে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে প্রথম জানয়বাদি সম্মেলন আয়োজন করতে প্ররোচনা দেয়।[৬]

জায়নবাদের বিশ্ব সম্মেলন ও জায়নবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা

জায়নবাদের প্রথম বিশ্ব সম্মেলনটি ইহুদি বুদ্ধিজীবী ও পুঁজিপতিদের উপস্থিতিতে আয়োজিত হয় এবং তারা সফলভাবে নিজেদের কাজের পরিসমাপ্তি ঘটায়। সম্মেলনের উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে, জায়নবাদ ধারণাটি বাস্তবিক রূপ লাভের নিকটবর্তী হয়ে ওঠে। হার্জল ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানের উপর স্পষ্টভাবে জোর দেয়নি। এমনকি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ব্যাপারে তার কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত ছিল না। যদিও কেউ কেউ উগান্ডা ও আর্জেন্টিনার মতো কিছু দেশের প্রস্তাব দিয়েছিল। হার্জল তার বইয়ে প্রস্তাব করেন: “সংগঠনের আলোচনা ও রাজনৈতিক পরিকল্পনার কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য একটি প্রতিনিধি অফিস গঠন এবং আন্দোলনের আর্থিক চাহিদা মেটাতে একটি ইহুদি কর্পোরেশন তৈরি করা উচিত।[৭]

তাই জায়নবাদ গঠনের শুরুতে এ দলের নেতারা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, বরং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং এর ছত্রছায়ায় ইহুদিদের একত্রিত করা। তদনুসারে, যেহেতু "ইহুদি রাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠার ধারণাটি কেবল একটি সহায়ক এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম হিসাবে বিবেচিত ছিল, তাই এই কেন্দ্রটি স্থাপনের স্থান নিয়ে জায়নবাদীদের দিক থেকে খুব বেশি গুরুত্ববহ ছিল না, যেমনটা লিও পিঙ্কার এই প্রসঙ্গে লেখেন, “আমাদের এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই যে, আমাদের অবশ্যই সেখানে বাস করতে হবে, যেখানে কোন এক সময় আমাদের শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ... আমাদের কেবল এক টুকরো জমি দরকার, যা আমাদের মালিকানাধীন হবে... আমরা কুদস-আল আক্বসকে, যা আমরা আমাদের প্রাচীন জন্মভূমি ধ্বংস হওয়ার পর থেকে সংরক্ষণ ও হেফাজত করছি, সেটাকে ঐখানে নিয়ে যাব। আমি বোঝাতে চাচ্ছি আল্লাহ ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রতি বিশ্বাসকে, কেননা এগুলোই আমাদের মাতৃভূমিকে একটি পবিত্র ভূমিতে পরিণত করেছে (জর্ডান বা জেরুজালেম নয়)।[৮]

জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য ছিল; যতদিন জায়নবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতা হার্জল জীবিত ছিল, ততদিন তিনি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, বিশেষত ফিলিস্তিনের প্রতি বিশেষ সংবেদনশীল ছিলেন না। উনিশ শতকে, ষষ্ঠ জায়নবাদী সম্মেলনে, উগান্ডাকে শানসব্যবস্থার কেন্দ্র হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। একই কংগ্রেসে হার্জল ঘোষণা দেন, “আমি এ বিষয়ে সুনিশ্চিত যে, ইহুদি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলন এই প্রস্তাব স্বীকৃতিসহকারে গ্রহণ করবে। প্রস্তাবটি হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকায় একটি স্বায়ত্তশাসিত ইহুদি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা হবে যেখানে একটি ইহুদি প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার থাকবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন একজন উচ্চপদস্থ ইহুদি কর্মকর্তা। বলাই বাহুল্য, এ সবই হবে ব্রিটিশদের চূড়ান্ত তত্ত্বাবধানে।[৯]

এ বিষয়ে দ্বিতীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গিও প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের মধ্যে প্রথম থেকেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের প্রতি বিশেষ সংবেদনশীলতা এবং বিশেষ আকর্ষণ ছিল এবং তারা এটিকে প্রতিশ্রুত মুক্তিদাতার ভূখণ্ড হিসাবে বিবেচনা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিকে খণ্ডন করার জন্য কিছু মতামত প্রকাশ করেছিলেন, যেমন চেইম ওয়েজম্যান লেখেন, “প্রস্তাবিত অঞ্চলগুলি হয় খুবই ঠান্ডা বা অত্যধিক গরম, এবং শুধু সেগুলোর উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য বছরের পর বছর কাজ এবং আকাশচুম্বী খরচের প্রয়োজন।[১০]

অবশ্যই লক্ষ করা উচিত যে, জায়নবাদী ব্যবস্থার নেতৃত্ব এমন একদল লোক নিয়ে গঠিত ছিল, যাদের প্রত্যেকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল; যেমন: অনেকে আলফ্রেড নসিকের ন্যায় জার্মানপন্থী ছিল, চেইম ওয়েজম্যানের মত একদল ব্রিটিশপন্থী ছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী অন্যান্য রাষ্ট্রপন্থী দলও ছিল। মতভিন্নতার কারণে এ বিষয়ে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত জায়নবাদী নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে ওয়েজম্যানের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশপন্থী গোষ্ঠীর বিজয় দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। ঘটনাটি এমন সময় ঘটে যে ব্রিটিশ মহলে একদল দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের প্রতি নজর দিয়ে আসছিল, তারাই প্রাধান্য লাভ করে এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনে তাদের শাসনব্যবস্থার ভিত্তিস্থাপন করে।[১১]

তথ্যসূত্র

  1. আশুরি, দারিউশ, দানেশনমে সিয়াসি, তেহরান, ইন্তেশারাতে মুরভারিদ, ১৩৮০ সৌরবর্ষ, পৃ. ১২৩।
  2. জু’আইতার, আকরাম, সারগোযাশতে ফিলিস্তিন, অনুবাদ: আকবর হাশেমি রাফসানজানি, কোম, বুস্তানে কিতাব, ১৩৮৮ সৌরবর্ষ, পৃষ্ঠা ৯১-৯২।
  3. জু’আইতার, সারগোযাশতে ফিলিস্তিন, পৃ. ৯২।
  4. জু’আইতার, সারগোযাশতে ফিলিস্তিন, পৃ. ৯২।
  5. সোকোলভ, নাহুম, তারিখে জায়নিজম, অনুবাদ: দাউদ হায়দারি, তেহরান, মুয়াস্সেসায়ে মুতালিয়াতে তারিখে ইসলাম, ১৩৭৭ সৌরবর্ষ, খণ্ড ১, পৃ. ৩৮৫।
  6. সোকোলভ, তারিখে জায়নিজম, খণ্ড ১, পৃ. ৩৮৫।
  7. ইভানভ, ইউরি, জায়নিজম, অনুবাদ: ইব্রাহিম ইউনুসি, তেহরান, মুয়াস্সেসায়ে ইন্তশারাতে আমির কবির, ১৩৫৬ সৌরবর্ষ, পৃ. ১৪।
  8. ইভানভ, ইউরি, জায়নিজম, পৃ. ১৪।
  9. ইভানভ, ইউরি, জায়নিজম, পৃষ্ঠা ২০-২১।
  10. ইভানভ, ইউরি, জায়নিজম, পৃ. ৮২।
  11. ইভানভ, ইউরি, জায়নিজম, পৃ. ৮৬।