বিদ্বেষ
বিদ্বেষ কি? বিদ্বেষের পরিণতিসমূহ ও উপাদানসমূহ কি কি? এ থেকে মুক্তির উপায় কি?
বিদ্বেষ এক ধরনের হীন নৈতিকতা এবং আত্মিক একটি অবস্থা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার অন্তরে অন্যের প্রতি শত্রুতা লুকিয়ে রাখে এবং উপযুক্ত সময়ে তা প্রকাশ করে। রাগের আলামতসমূহের মধ্যে বিদ্বেষকে বিবেচনা করা হয়। বিদ্বেষ প্রতিকারের উপায়সমূহ হচ্ছে বিদ্বেষের পরিণতির দিকে লক্ষ্য করা, ক্ষমা করার মানসিকতা শক্তিশালী করা এবং বিদ্বেষের শিকার হওয়া ব্যক্তির সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা। বিদ্বেষের উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে নিজের মধ্যে ঘাটতি বা কমতি’র অনুভূতি যার কারণে ব্যক্তি অন্যদের সফলতাসমূহ দেখে তাদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে ওঠে।জিদাল-এ লাফযি (মৌখিক ঝগড়া-বিবাদ), ভর্ৎসনা, গীবত, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অভিশাপ ও অশ্লীল গালিগালাজ হচ্ছে অন্য উপাদানসমূহ, যা প্রতিপক্ষের প্রতি ব্যক্তির অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।
পরিভাষা পরিচিতি এবং অবস্থান
বিদ্বেষ হচ্ছে একটি আত্মিক অবস্থা; যে অবস্থায় ব্যক্তি মনে মনে অন্যের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে এবং একটি উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকে সেটি প্রকাশ করা জন্য।[১] বিদ্বেষ কেবলমাত্র একটি মানসিক অবস্থা এবং যদি বিদ্বেষের প্রভাব বিন্যাস করলে তাকে দুশমনী বা শত্রুতা বলে অভিহিত করা হয়। বিদ্বেষকে রাগের অন্যতম আলামত হিসেবে বিবেচনা করা হয়; কেননা, যখন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির উপর রাগান্বিত হয় এবং রাগকে প্রকাশ করতে সক্ষম না হয়, তখন রাগ তার অন্তরে জমা হতে থাকে। আর এর ফলে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়।[২] রেওয়ায়েত অনুসারে, বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি প্রকৃত ঈমান থেকে বঞ্চিত।[৩]
উপাদানসমূহ
বিদ্বেষের জন্য বিভিন্ন উপাদানসমূহের কথা বলা হয়েছে:
- জিদাল-এ লাফযি (মৌখিক ঝগড়া-বিবাদ): রেওয়ায়েতে, যে জ্ঞানগত আলোচনাসমূহ ঝগড়া-বিবাদে রুপান্তরিত হয়, এমনভাবে যে দুই পক্ষের কেউই কারও কথা গ্রহণ করে না, তা অব্যাহত রাখতে নিষেধ করা হয়েছে; কেননা এরূপ আলোচনা অব্যাহত রাখলে বিদ্বেষ ও দুশমনীর সৃষ্টি হয়।[৪]
- মিরা (নিন্দনীয় তর্ক): মিরা’র অর্থ অন্যের কথার দোষ ধরা, বন্ধুত্বকে নষ্ট করে এবং বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।[৫]
- অত্যধিক প্রত্যাশা ও তিরস্কার: রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, মানুষ যদি অন্যের নিকট হতে তার কর্ম সক্ষমতার অতিরিক্ত প্রত্যাশা করে থাকে এবং তার প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম না হওয়ার কারণে তাকে তিরস্কার করা হয় তবে, তার মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়।[৬]
- কমতি বা ঘাটতির অনুভূতি: যে ব্যক্তি তার নিজের মধ্যে কমতি বা ঘাটতির অনুভব করে, সে যখন অন্যদের সফলতার প্রতি লক্ষ্য করে, তখন তাদের ব্যাপারে বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।[৭]
- গীবত: কখনও কখনও গীবতের কারণে গীবতকারী ব্যক্তির প্রতি গীবতের শিকার হওয়া ব্যক্তির মনে বিদ্বেষের উদ্রেক ঘটে; কেননা গীবতকারী ব্যক্তি অন্যদের নিকট তার মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে।[৮]
- ঠাট্টা-বিদ্রুপ: কেউ যদি অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং ঐ ব্যক্তি যদি নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম না হয়, তবে তার অন্তরে রাগ দানা বাঁধে এবং সুযোগ মতো আঘাত হানার লক্ষ্যে তা বিদ্বেষে রুপান্তরিত হয়।[৯]
- অভিশাপ: লানত ও অভিশাপ বলতে নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয় অভিশাপের কথা বুঝানো হয়েছে; কেননা কিছু কিছু ক্ষেত্রে লানত বা অভিশাপ জায়েয।[১০]
- অশ্লীল গালিগালাজ: অশ্লীল গালিগালাজ করার কারণে অশ্লীল ভাষী ব্যক্তির প্রতি মানুষের মনে বিদ্বেষের উদ্রেক ঘটে।[১১]
পরিণতিসমূহ
বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি সর্বদা আযাব ভোগ করতে থাকে এবং কখনও স্বস্তি অনুভব করে না। বন্ধুত্বের প্রতি অটল না থাকার কারণে তার বন্ধুর সংখ্যা কম হয়। বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তিকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি প্রকৃত ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়; কেননা রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে মু’মিন ব্যক্তির অন্তরে এক মুহূর্তের বেশী বিদ্বেষের স্থান নেই এবং যখন তার ভাইয়ের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যায়, তখন তার প্রতি কোন বিদ্বেষই তার মনে অবশিষ্ট রাখে না।[১২] বিদ্বেষ অন্যান্য গুনাহসমূহ যেমন: হিংসা, গীবত, অপবাদ, তিরস্কার, কঠোর ভর্ৎসনা এবং অবজ্ঞার কারণ হয়।
প্রতিকার
কেউ কেউ বিদ্বেষ থেকে মুক্তির জন্য নিম্নোক্ত উপায়সমূহের কথা উল্লেখ করেছেন:
- বিদ্বেষের পরিণতির প্রতি লক্ষ্য করা: এ ব্যাপারে সজাগ হওয়া যে, বিদ্বেষী ব্যক্তির জন্য বিদ্বেষপরায়ণতায় কোন উপকারই নেই, বরং এর ফলে সে সর্বদা মানসিক অশান্তিতে ভুগবে।
- ক্ষমার মানসিকতা শক্তিশালী করা: যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির দ্বারা কষ্ট বা অবমাননার শিকার হয়, তবে ঐ ব্যক্তির উপর রাগ ও বিদ্বেষ পোষণের পরিবর্তে ক্ষমা নামক মহৎ গুণের মাধ্যমে তাকে ক্ষমা করতে হবে। কেননা, মহানবী (স.)-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ক্ষমাশীলতা মানুষের মর্যাদা ও মহত্ত্বকে আরও বৃদ্ধি করে।[১৩]
- বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা: তার দাবি-দাওয়া ও চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হওয়া এবং তার ভালোত্বগুলোকে বৈঠকসমূহে উল্লেখ করা।[১৪]
তথ্যসূত্র
- ↑ নারাগী, আহমেদ, মেরাজ আল-সাদাহ, কাশফ আল-গীতাহ প্রকাশক, প্রথম সংস্করণ, ৮২, পৃ. ২০০।
- ↑ নারাগী, আহমেদ, মেরাজ আল-সাদাহ, কাশফ আল-গীতাহ প্রকাশক, প্রথম সংস্করণ, ৮২, পৃ. ২০০।
- ↑ মোহাম্মদী রায় শাহরি, মিজান আল-হিকমা, হামিদরেজা মাশায়িখি দ্বারা অনুবাদ, দার আল-হাদিস পাবলিশিং হাউস, 1ম সংস্করণ, ১৩৭৭, খণ্ড ৩, পৃ. ১২২১, অধ্যায় হক।
- ↑ আমেলি জুবাই, জয়ন আল-দিন বিন আলী (শহীদ দ্বিতীয় নামে পরিচিত)। আল-মুফিদ এবং আল-মুস্তাফিদের সাহিত্যে আল-মুরিদের সতর্কতা। বাব আল-মারা
- ↑ তেহরানী, মোজতাবি, ইলাহ এলাহী, কালচারাল ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পরারি নলেজ অ্যান্ড থট দ্বারা প্রকাশিত, প্রথম সংস্করণ, ২০০৮, খণ্ড ৪, পৃ. ১৭৩-১৭৪4।
- ↑ মোহাম্মদী রায় শাহরি, মিজান আল-হিকমা, হামিদরেজা মাশায়িখি দ্বারা অনুবাদ, দার আল-হাদিস পাবলিশিং হাউস, 1ম সংস্করণ, ১৩৭৭, খণ্ড ৩, পৃ. ১২২১, অধ্যায় হক।
- ↑ মোহাম্মদী রায় শাহরি, মিজান আল-হিকমা, হামিদরেজা মাশায়িখি দ্বারা অনুবাদ, দার আল-হাদিস পাবলিশিং হাউস, 1ম সংস্করণ, ১৩৭৭, খণ্ড ৩, পৃ. ১২২১, অধ্যায় হক।
- ↑ ইবন আবি আল-হাদীদ, শারহ নাহজ আল-বালাগেহ, 20 খণ্ড, বৈরুত, দারাহিয়া আল-ত্রাথ, ১৩৮৫ হি, খণ্ড.২০, পৃ. ৩২২, হি. ৬৯৬ এবং পৃ. ৩২৭, হি. ৭৪৩।
- ↑ তেহরানি, মোজতাবি, এহলাক এলাহী, কালচারাল ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পোরারি নলেজ অ্যান্ড থট এর প্রকাশক, 1ম সংস্করণ, ২০০১, ভলিউম ৪, পৃ. ৯৫ বা ৬৫।
- ↑ তেহরানী, মোজতাবি, এহলাক এলাহী, কালচারাল ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পোরারি নলেজ অ্যান্ড থট এর প্রকাশক, প্রথম সংস্করণ, ২০০৮, খণ্ড ৪, পৃ. ২৯+৫।
- ↑ তেহরানী, মোজতাবি, এহলাক এলাহী, কালচারাল ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পোরারি নলেজ অ্যান্ড থট এর প্রকাশক, প্রথম সংস্করণ, ২০০৮, খণ্ড ৪, পৃ.২৪৭।
- ↑ মোহাম্মদী রায় শাহরি, মিজান আল-হিকমা, হামিদরেজা মাশায়িখি দ্বারা অনুবাদ, দার আল-হাদিস পাবলিশিং হাউস, 1ম সংস্করণ, ১৩৭৭, খণ্ড ৩, পৃ. ১২২১, অধ্যায় হক।
- ↑ তেহরানী, মোজতাবি, এহলাক এলাহী, কালচারাল ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পরারি নলেজ অ্যান্ড থট এর প্রকাশক, 1ম সংস্করণ, ২০০৮, ভলিউম ৪, পৃ.২৭০।
- ↑ নারাগী, আহমেদ, মেরাজ আল-সাদাহ, পৃ.২০১।