ওহাবীদের দৃষ্টিতে তাওয়াসসুল

Wahidshia (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০১:১৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (ابرابزار)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
প্রশ্ন

ওহাবীরা কুরআন ও আহলে বাইত (আ.)-এর তাওয়াসসুলের বিষয়টি সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে, তাদের যুক্তি কীভাবে খণ্ডন করা যায়?


শিয়া মাযহাবে, মহানবী (স.)আহলে বাইত (আ.)-এর তাওয়াসসুল একটি বৈধ ও কার্যকরী আমল হিসেবে বিবেচিত হয়। মুমিনরা বিশ্বাস করেন যে, আহলে বাইত (আ.) আল্লাহ ও বান্দাদের মধ্যে মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারেন এবং তারা এই দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষের জন্য শাফায়াত করতে পারেন। আর তারা কঠিন পরিস্থিতির সময়গুলোতে মুমিনগণের ডাকে সাড়া প্রদান ও সাহায্য করতে পারেন। এই আমলকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও দোয়া কবুলের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়।

ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে মুমিনরা আহলে বাইত (আ.)-এর মাধ্যমে তাওয়াস্সুল করেছেন এবং তাদের নিকট সাহায্য সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রসিদ্ধ যিয়ারতসমূহ যেমন যিয়ারতে আশুরা ও যিয়ারতে জামে' কাবীরা হলো এমন দুআ যেখানে আহলে বাইত (আ.)-এর সাহায্য ও সুপারিশ শাফায়াত তথা সুপারিশের প্রতি ইঙ্গিত দেওযা হয়েছে। এই আমলগুলি ঈমান শক্তিশালী করা এবং আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

মুসলিম ইতিহাস জুড়ে সমস্ত মুসলমানদের মধ্যে অন্যতম প্রচলিত বিষয় হচ্ছে আল্লাহর ওলি-আউলিয়াদের নিকট ইস্তিগাসা (সাহায্য প্রার্থনা) ও একটি সাধারণ প্রথা ছিল ওলি-আওলিয়াদের কাছে ইস্তিগাসা (সাহায্য প্রার্থনা) ও হাজতের (প্রয়োজন পূরণ) আবেদন জানানো, যা সকল মুসলমানের নিকট গ্রহণযোগ্যও বটে। একমাত্র ওহাবীরা ব্যতীত সকল মুসলমান এই আমলটিকে জায়েয ও বৈধ জ্ঞান করেন। বাস্তবে, ইস্তিগাসা করার মাধ্যমে মানুষ মহানবী (স.) ও মাসুম ইমামগণ (আ.)-এর উপস্থিতিকে অনুগ্রহ লাভের মাধ্যম হিসেবে স্থান দেন, পাশাপাশি এই বিশ্বাস পোষণ করেন যে, সবকিছুই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এখতিয়ারাধীন। তবে একই সাথে, ওহাবী মতাদর্শের আলেমরা এক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তাধারার অধিকারী এবং এই আমলটিকে জায়েয তথা বৈধ জ্ঞান করেন না।

তাওয়াসসুল সম্পর্কে ওহাবীদের কোন স্থায়ী দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত নেই। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব এটিকে ইসলামের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন এবং কাফির হওয়ার প্রমাণ হিসেবে মনে করতেন। তবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাম ও সিফাত (গুণাবলী) এবং কুরআনের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়াকে জায়েয বা বৈধ জ্ঞান করেন। সমসাময়িক ওহাবীরা তাওয়াসসুলের ধারণাটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে, তাওয়াসসুল সম্পর্কে মুসলমানদের অন্য সব ফিরকা ও মাযহাবসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি ওহাবীদের থেকে ভিন্ন। এছাড়াও কুরআন, রেওয়ায়েত ও আলেমগণের বক্তব্যসমূহেও তাওয়াসসুল বৈধ হওয়ার স্বপক্ষের দলিল বিদ্যমান রয়েছে।

ভূমিকা

পরিভাষা

১. তাওয়াসসুল

আরবি ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে তাওয়াসসুল শব্দটি ”ওয়াসিলা” «وسل» মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো কোনো মাধ্যম বা কাজের মাধ্যমে নিকটবর্তী হওয়া বা সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করা বলে মনে করা হয়। ফাইয়ূমী এই শব্দটিকে ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন: "তাওয়াসসালা ইলা রব্বিহি বিওয়াসিলা"—অর্থাৎ, "সে একটি আমলের মাধ্যমে তার রবের নিকটবর্তী হয়েছে।"[১] এই সংজ্ঞা লিসানুল আরব গ্রন্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[২]

পরিভাষাগত দিক থেকে, "তাওয়াসসুল" হলো আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের প্রচেষ্টা। সাধারণত তাওয়াসসুল এর অর্থ হলো এই যে, বান্দা আল্লাহর সমীপে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করে, যেন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তাই ধর্মীয় পরিভাষায় বলা হয়েছে: "তাওয়াসসুল হলো কোনো উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে মাধ্যম অবলম্বন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা।"[৩] আয যিয়ারাতু ওয়াত তাওয়াসসুল-এর লেখক তাওয়াসসুলকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন: বান্দা যা কিছুর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে, যা তার দোয়া কবুল ও চাহিদা পূরণের মাধ্যম।[৪]

তবে, এর অর্থ এই নয় যে, তারা সরাসরি মহানবী (স.) বা ইমামদের (আ.) নিকট স্বাধীনভাবে কিছু চাইবে। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সৎকর্ম, নবী মহানবী (স.)ইমামদের (আ.) আনুগত্য, তাদের শাফায়াত, অথবা তাদের মর্যাদা ও আদর্শের শপথ ও দোহাই দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করা।[৫]

সুতরাং, শাব্দিক ও পারিভাষিক দিক থেকে তাওয়াসসুলের সংজ্ঞার মধ্যে সামঞ্জস্য বিদ্যমান রয়েছে। আর উভয় ক্ষেত্রেই নৈকট্য অর্জন ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

২. ইস্তিগাসা

"ইস্তিগাসা" শব্দটি অর্থগত দিক থেকে "তাওয়াসসুল" এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আর এটি "গাওস" মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সাহায্য ও সহায়তা।[৬] যখন এটি বাবে ইস্তিফআল রূপে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় সাহায্য প্রার্থনা বা সহায়তা চাওয়া। এমতাবস্থায়, এটি তাওয়াসসুলের সমার্থক হয়ে ওঠে।

যেরূপভাবে নবী করিম (স.)-এর নিম্নোক্ত হাদিসটিতে "তাওয়াসসুল"-এর স্থানে "ইস্তিগাসা" শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে: «ان الشمس تدعوا یوم القیامة حتی یبلغ العرق نصف الاذن فبینما هم کذلک استغاثوا بآدم ثم موسی ثم بمحمد صلی الله علیه و السلم؛ কিয়ামতের দিন সূর্য এত কাছে চলে আসবে যে ঘাম কানের মধ্যভাগ পর্যন্ত পৌঁছাবে। সেই মুহূর্তে মানুষ তীব্র গরম ও প্রচন্ড তাপে অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় প্রথমে হযরত আদম (আ.)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে, অতঃপর হযরত মূসা (আ.)-এর কাছে এবং অতঃপর হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর শরণাপন্ন হবে।»[৭]

৩. শাফায়াত (মধ্যস্থতা)

শিন-ফা-আইন «ش-ف-ع» শাফায়াত শব্দটি মূল থেকে উদ্ভূত, যা দুই বা ততোধিক বস্তুর একত্রে জোড় হওয়ার ধারণাকে নির্দেশ করে। তাই, মৌলিক অর্থে, শাফায়াত হল কিয়ামতের দিন দোযখ হতে পরিত্রাণ লাভের জন্য আওলিয়া ও আম্বিয়াদের নিকট সাহায্য চাওয়া। অবশ্য এটিও এক প্রকারের তাওয়াসসুল।

সামহূদী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: «التوسل به صلی الله تعالی علی و سلم فی عرصات القیامة فیشفع الی ربه تعالی؛ কিয়ামতের ময়দানেও আল্লাহর রাসূলের (স.) তাওয়াসসুল রয়েছে, সুতরাং তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট শাফায়াত করবেন»[৮] অবশ্য এই অর্থে শাফায়াত শব্দটি কখনও কখনও নিরঙ্কুশভাবে তাওয়াসসুল অর্থে ব্যবহৃত হয়।

ওহাবী মতাদর্শে তাওয়াসসুল

ওহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি

ওহাবীদের কেউ কেউ তাওয়াসসুলকে বৈধ ও অবৈধ দুইটি বিভাগে ভাগ করেন। তাওয়াসসুলের বৈধ একটি রূপ হল আল্লাহর নাম ও সিফাত তথা গুণাবলীর তাওয়াসসুল করা (আল্লাহর নাম ও সিফাতের মাধ্যমে সহায়তা প্রার্থনা)। ওহাবীদের মতানুসারে, আল্লাহর নাম ও বৈশিষ্ট্যগুলির মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হওয়া জায়েয তথা বৈধ। তাদের মতের স্বপক্ষের দলিল হিসেবে তারা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির উল্লেখ করে ﴾وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَی فَادْعُوهُ بِهَا؛ সবচেয়ে সুন্দর নামগুলি আল্লাহরই, সুতরাং, এই নামগুলির মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করো।﴿(আল-আ'রাফ:১৮০)[৯]

এছাড়াও কুরআনের কোন কোন আয়াত অনুসারে যেমন: «و ان المساجد لله فلا تدعوا مع الله احدا»، «قل لله الشفاعه جمیعا»، «ویعبدون من دون الله ما لا یضرهم ولا ینفعهم ویقولون هؤلاء شفعاؤنا عند الله قل اتنبئون الله بما لا یعلم فی السموات ولا فی الارض سبحانه وتعالی عما یشرکون» আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে যেকোন মধ্যস্থতাকারীর স্থান দেওয়াই হচ্ছে শিরক।[১০][১১][১২][১৩]

ওহাবীরা কুরআনের তাওয়াসসুলকে জায়েজ বা বৈধ বলে মনে করেন, কারণ কুরআনকে আল্লাহর অন্যতম সিফাত হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা বলেন, কুরআনের তাওয়াসসুল বৈধ, কেননা, শব্দ ও অর্থগত দিক থেকে কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম। আর আল্লাহর কালাম হচ্ছে আল্লাহর অন্যতম সিফাত বা গুণ। তাই কুরআনের তাওয়াসসুল করা মানে আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীর মধ্যে একটি গুণের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাসিল করা। আর এই বিষয়টি তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং শিরকে উপনীত হয় না।[১৪]

কিন্তু তারা আওলিয়াগণ, নবীগণ এবং মহানবী (স.) এর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদেরকে তাওয়াসুল তথা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাকে অবৈধ জ্ঞান করেন। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব বলেন,

"যদি কেউ বলে: 'হে আল্লাহ, আমি তোমার নবী (স.) এর মাধ্যমে তোমার নিকট প্রার্থনা করছি যে, আমাকে তোমার রহমতের অন্তর্ভূক্ত করো, তবে ঐ ব্যক্তি শিরকের পথে চলে গেছে এবং তার আকীদা বা বিশ্বাস হচ্ছে শিরকারীদের আকীদা’র অনুরূপ।"[১৫][১৬]

সমসাময়িক যুগের ওহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি

আধুনিক যুগের ওয়াহীরা, এই বিষয়ে নানাবিধ হোঁচট খেয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, আল্লাহর ওলি-আউলিয়াদের প্রতি তাওয়াসসুলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন[১৭]:

  1. প্রথম প্রকার হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জীবিত কোন ওলি’র নিকট অনুরোধ করেন, তিনি যেন মহান আল্লাহর নিকট তার (ঐ ব্যক্তির) জন্য যেমন, রিযিক বৃদ্ধি বা অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করা প্রভৃতি বিষয়গুলোর জন্য প্রার্থনা করেন। তবে, আধুনিক যুগের ওহাবীদের দৃষ্টিতে এই ধরনের তাওয়াসসুল জায়েয।
  2. আল্লাহর ওলিগণের প্রতি দ্বিতীয় প্রকারের তাওয়াসসুল হল, সরাসরি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সম্বোধন করা এবং ও নিজের ও পয়গম্বরের মধ্যকার অথবা নিজের ও আল্লাহর আউলিয়া’র মধ্যকার বিদ্যমান ভালবাসা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়া। তাদের মতে এই ধরণের তাওয়াসসুলও জায়েয বা বৈধ । উদাহরণস্বরূপ, বলা যেতে পারে: «اللهم إنی أسألك بحبی لنبیك واتباعی له وبحبی لأولیائك أن تعطینی كذا؛ হে আল্লাহ! তোমার নবীর প্রতি আমার ভালবাসা, তাঁর প্রতি আমার আনুগত্য এবং তোমার ওলিদের প্রতি আমার ভালোবাসার মাধ্যমে আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি যে, আমাকে এই বা ঐ জিনিস দান কর।»
  3. আল্লাহর ওলিগণের প্রতি তৃতীয় প্রকারের তাওয়াসসুল হচ্ছে আল্লাহর নবী (স.) এবং ওলিগণের মাকাম ও পদমর্যাদার তাওয়াসসুল করা। উদাহরণস্বরূপ, বলা যেতে পারে: «اللهم إنی أسألك بجاه نبیك أو بجاه الحسین؛ হে আল্লাহ! তোমার নবীর মর্যাদা বা হুসায়নের মর্যাদার দোহাই দিয়ে আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি।» ওহাবীদের মতে, এই ধরনের তাওয়াসসুল বৈধ নয়। এরূপ তাওয়াসসুল যেহেতু নবীগণ ও ওলিগণের মৃত্যুর পর সম্পাদিত হয়ে থাকে সেহেতু তা বৈধ নয়; যতই তারা শ্রেষ্ঠ মাকামের অধিকারী হন না কেন।
  4. আল্লাহর ওলিগণের প্রতি চতুর্থ প্রকারের তাওয়াসসুল হচ্ছে, সরাসরি ওলিগণের তাওয়াসসুল করে আল্লাহর নিকট চাহিদা পূরণের আবেদন জানানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, বলা যেতে পারে: «اللهم إنی أسألک کذا بولیک فلان أو بحق نبیک فلان؛ হে আল্লাহ! তোমার অমুক আউলিয়ার মাধ্যমে বা তোমার অমুক নবীর মাধ্যমে আমি তোমার কাছে এই বা ঐ প্রার্থনা করছি।» ওহাবীদের মতে, এই ধরনের তাওয়াসসুলও অবৈধ। তারা এটির অবৈধ হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, কোনো সৃষ্টির আল্লাহর উপর এমন কোনো অধিকার নেই যার মাধ্যমে আল্লাহকে কসম দেওয়া যায়, যাতে করে চাহিদা পূরণ হয়। ওহাবীদের মতে, এই ধরনের তাওয়াসসুল স্পষ্টভাবে শিরকের একটি রূপ।

মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওহাবের দৃষ্টিভঙ্গি

মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব তাওয়াসসুলকে ইসলামের অন্যতম লঙ্ঘন বলে মনে করেন। তিনি বলেন,

কেউ যদি আল্লাহ ও তার নিজের মধ্যে অন্যকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্থান দেয় এবং তাদের মাধ্যমে শাফায়াত কামনা করে, তবে সে কাফির হিসেবে পরিগণিত হবে।[১৮]

আহলে সুন্নতের আলেমগণ কর্তৃক ওহাবী মতের খণ্ডন

মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওহাবের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে রচিত হওয়া প্রথম গ্রন্থটি হচ্ছে 'আস-সাও'ইক আল-ইলাহীয়্যা ফির রাদ্দ আলাল ওয়াহাবীয়্যা'। গ্রন্থটি রচনা করেছেন খোদ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাবের ভাই সুলেমান বিন আবদুল ওহাব । তাওয়াসসুল সম্পর্কে ওহাবীদের বিচ্যুতিমূলক চিন্তাধারা সবসময়ই সুন্নি পন্ডিতদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে, যেমনভাবে আস সালামী এর বিবৃতিতেও বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে: «القول بجواز التوسل و استجابه هو قول جمهور علماء اهل السنه و الجماعه، بل هو قول المسلمین بجمیع فرقهم و مذاهبهم الا المذهب الذی ینتسب الیه مدعو السلفیه؛ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ পণ্ডিত, এমনকি মুসলমানদের সকল ফিরকা ও মাযহাবের মত অনুসারে, তাওয়াসসুলের বিষয়টি জায়েয বা বৈধ আর এক্ষেত্রে শুধু ব্যক্তিক্রম হচ্ছে সালাফিদের বানানো মতবাদ।»[১৯]

সাকাফ আল-কুরাইশী বলেন:

মহানবী (স.)-এর মাধ্যমে তাঁর প্রভুর কাছে সাহায্য ও শাফায়াত কামনা করার বিষয়টি কখনোই পূর্ববর্তী বা পরবর্তীদের দ্বারা আপত্তিকর হিসেবে গণ্য হয়নি, যতক্ষণ না ইবন তাইমিয়্যা এসে তা অস্বীকার করেন এবং সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হন। তিনি এমন মতাদর্শের সৃষ্টি করেন যা তাঁর আগে কোনো আলেমই উপস্থাপন করেন নি। যদি ইবন তাইমিয়্যার বক্তব্য সত্য হত, তাহলে মহানবী (স.) কেন এক ব্যক্তিকে তাঁর (স.) মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার শিক্ষা দেন । যেমন তিনি বলেন: «اللهم إنی أتوجه الیک بنبیک محمد نبی الرحمة؛ হে আল্লাহ! আমি তোমার নবী মুহাম্মাদ তথা রহমতের নবীর মাধ্যমে তোমার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি» তাহলে, তাওয়াসসুল করা সত্ত্বেও, এটা কি সর্বশক্তিমান আল্লাহর পত শিরক? আর মহানবী (স.) কি এমন শিক্ষা দেন যা মানুষকে শিরকের দিকে ঠেলে দেয়? মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রশংসা সম্পর্কে এটা একটা বিরাট অপবাদ।[২০]

মহানবী (স.) এর আহলে বাইতের প্রতি ইমাম শাফেয়ীর তাওয়াসসুল

সাওয়ায়েকুল মুহরিকা গ্রন্থে ইবনে হাজর মাক্কী আহলে সুন্নতের অন্যতম বিশিষ্ট ইমাম শাফেয়ী হতে বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম শাফেয়ী মহানবী (স.) এর আহলে বাইতের প্রতি তাওয়াসসুল করতেন।[২১] তিনি ইমাম শাফেয়ীর এই বিখ্যাত কবিতাটি উল্লেখ করেন:

  • "মহানবীর (স.) আহলে বাইত আমার চাওয়ার মাধ্যম,
  • আর আল্লাহর নিকটে, তারা আমার শাফায়াতকারী;
  • তাদের মাধ্যমে আমি আশাবাদী যে,
  • আগামী দিনে (কিয়ামতের দিন), আমার কর্মফল আমার ডান হাতে থাকবে।"

এই রেওয়ায়েতগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, চাহিদা মিটানো ও অভাব পূরণের লক্ষ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল করা বৈধ। এমনকি (প্রথম হাদিস অনুসারে) মহানবী (স.) নিজেই ঐ অন্ধ ব্যক্তিটিকে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, সে যেন তার নিজের এবং আল্লাহর মাঝে মহানবী (স.)-কে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আল্লাহর নিকট তার চাহিদা পূরণের আবেদন জানায়। আর তাওয়াসসুলের প্রকৃত দর্শন এটাই যে, অভাবগ্রস্থ ও গুনাহগার মানুষেরা আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্য হাসিলকারী ব্যক্তিদেরকে ওয়াসিলা বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, নিজেদের আসল লক্ষ্যে পৌঁছাবে।

শিয়া মাযহাবে তাওয়াসসুল

তাওয়াসসুল সম্পর্কে শিয়া সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি

তাওয়াসসুল শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো কোনো মাধ্যম বা উপায় (ওয়াসিলা) নির্বাচন করা। আর ওয়াসিলা বলতে সেই জিনিস বোঝায়, যা একজন ব্যক্তিকে অন্যজনের নিকটবর্তী করে। লিসানুল আরব’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর নিকটে তাওয়াসসুল করা এবং ওয়াসিলা (মাধ্যম) বেছে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে যে, মানুষ এমন একটি কাজ সম্পাদন করবে যা তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে, আর মাধ্যম মানে এমন কিছু যার সাহায্যে মানুষ অন্য কিছুর নিকটবর্তী হয়। সুতরাং, তাওয়াসসুল বলতে নিকটবর্তী হওয়াকেও বুঝায়, আবার সেই বিষয়কেও বুঝায়, যার মাধ্যমে অন্যের নিকটবর্তী হওয়া যায়।[২২]

ওহাবীদের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে যে, তারা তাওয়াসসুলের ক্ষেত্রে আল্লাহর ওলিগণকে দুঃখ-কষ্ট দূরকারী, চাহিদা পূরণ ও সমস্যা সমাধানের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র উৎস বলে মনে করেন। অথচ তাওয়াসসুলের আসল অর্থ এটা নয়। কেননা, যখন আমরা নবী করিম (স.) এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল করি তখন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমরা তাঁকে কোনো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে বিবেচনা করি না, আমরা তাঁকে ইবাদত করি না। কুরআনে যে তাওয়াসসুলের আহ্বান জানানো হয়েছে তা হচ্ছে, আমরা মহানবী’র (স.) মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করব অর্থাৎ তিনি (স.) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সমীপে আমাদের জন্য শাফায়াত করবেন।[২৩]

বিষয়টি ঠিক এমন যে, কেউ এমন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে যেতে চায়, যাকে সে চেনে না; তখন সেই ব্যক্তি ঐ বিশিষ্ট ব্যক্তির পরিচিত এক ব্যক্তিকে তার সাথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, যাতে উক্ত ব্যক্তিকে ঐ বিশিষ্ট ব্যক্তির নিকট পরিচয় করিয়ে দেয় এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির নিকট থেকে এই ব্যক্তির জন্য সাহায্য নেয়। এই কাজ যেমনভাবে ইবাদত তেমনিভাবে প্রভাবের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বা স্বতন্ত্রতাও নয়। ক্ষমতার উৎসও নয় প্রচেষ্টা, সুতরাং, তাওয়াসসুল শিরক- এ সংক্রান্ত অভিযোগ যুক্তিহীন।[২৪]

তদুপরি, ওহাবীদের এই দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে কুরআনের শিক্ষার বিরোধী। আর তাই, সুন্নি ও শিয়া পণ্ডিতগণ পক্ষই এই ধারণাকে ওহাবীদের উদ্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করে, তা প্রত্যাখ্যান করেন। ওহাবীরা এমন ধারণা প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানদের তাকফির তথা কাফির সাব্যস্তকরণের চেষ্টা করেন এবং এর মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেন। সাবাকি নামক একজন সুন্নি পণ্ডিত বলেছেন, মহানবী (স.) এর ওয়াসিলায় সাহায্য ও সুপরিশ কামনা করা আল্লাহর নিকট একটি পছন্দনীয় বিষয়। পূর্ববর্তী বা বর্তমান প্রজন্মের কেউই এটাকে প্রত্যাখ্যান করেননি, যতক্ষণ না ইবনে তাইমিয়্যা এসে এটাকে অস্বীকার করে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হন। তিনি এমন কিছু উদ্ভাবন করেন, যা ইতিপূর্বে কোনো পন্ডিত বলেননি। আর এই বিদআত তথা নতুন উদ্ভাবনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।[২৫]

কুরআনে তাওয়াসসুল

তাওয়াসসুল সম্পর্কে ওহাবীদের এই আকীদা-বিশ্বাস, কুরআনের বেশ কিছু আয়াতের সাথে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক। কুরআন শরীফে অনেক আয়াত রয়েছে যা চাহিদা পূরণ, গুনাহ মাফ এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জনের জন্য তাওয়াসসুলের বৈধ হওয়ার বিষয়টিকে অনুমোদন করে। এর একটি উদাহরণ হিসেবে নিম্নলিখিত আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলছেন: ﴾یا أَیهَا الَّذینَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَ ابْتَغُوا إِلَیهِ الْوَسیلَه وَ جاهِدُوا فی سَبیلِهِ لَعَلَّکُمْ تُفْلِحُونَ؛ হে মু’মিনগণ (বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য মাধ্যম (ওয়াসিলা) অন্বেষণ কর, আর তাঁর পথে সংগ্রাম করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে সক্ষম হও।﴿(আল-মায়েদা:৩৫)

আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট পণ্ডিত ও তাফসীরুল মারাগি’র রচয়িতা বলেন, এই আয়াতে "ওয়াসিলা" বলতে সেই জিনিস বা বিষয়কে বোঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তার নৈকট্য লাভের জন্য পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অতঃপর তিনি সহীহ বুখারী ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থ থেকে একটি হাদিস তুলে ধরেন, যেখানে মহানবী (স.) ওয়াসিলা (মাধ্যম) হিসেবে উল্লেখিত হয়েছেন। উক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: «من قال حین یسمع النداء (الاذان) اللهم رب هذاه الدعوه التامه و الصلاة القائمة آت محمدا الوسیلة والفضیلة و ابعثه المقام المحمود الذی وعدته، حلت له شفاعتی یوم القیامه؛ অর্থাৎ "যে ব্যক্তি আযানের আহ্বান শুনে বলে, 'হে আল্লাহ! হে এই পরিপূর্ণ আহ্বান ও প্রতিষ্ঠিত নামাযের প্রভু! হযরত মুহাম্মাদ (স.)-কে ম ওয়াসিলা (মাধ্যম) ও শ্রেষ্ঠত্ব দান কর, আর তাকে সেই মহিমান্বিত স্থান (মাকাম মাহমুদ) এ উন্নীত কর, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাকে দিয়েছ'- কিয়ামতের দিনে আমার শাফায়াত তার জন্য অনুমোদিত হবে।»

এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, মহানবী (স.) নিজেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের একটি ওয়াসিলা তথা মাধ্যম। আর এই কারণেই, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি (স.) মাকামে মাহমুদের অধিকারী ছিলেন, যাতে কিয়ামতের দিন তাঁকে মু’মিনগণের পাপ ক্ষমার জন্য শাফায়াতকারী করা হয় এবং তিনিও তাদের জন্য শাফায়াত করেন। সুতরাং, তাওয়াসসুল কখনও শিরক বা কুফরের কারণ হয় না। যদি এরূপ হতো, তাহলে মহানবী (স.) এর ওয়াসিলা তথা মাধ্যম হওয়ার বিষয়টিও কুফর ও শিরকের বিষয় হতো।[২৬]

হাদিসে তাওয়াসসুল

শিয়া সূত্রগুলোতে তাওয়াসসুলের বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে, হাদিস উদ্ধৃত করার প্রয়োজন হয় না। অতএব, এ সংক্রান্ত আমরা কিছু হাদিস উল্লেখ করব, যা আহলে সুন্নত সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে:

১. খরার সময় নবী করিম (স.)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল

তাওয়াসসুলে শিরক বা কুফর না থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া ছাড়াও, মহানবী (স.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর (স.) মাধ্যমে তাওয়াসসুল করা, তাওয়াসসুলের বৈধতার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। বর্ণিত আছে যে, মদিনায় একবার ভয়াবহ খরা দেখা দেয়। একদল মানুষ এই সমস্যার সমাধান চেয়ে আয়েশা -এর কাছে যায়। আয়েশা তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে বলেন:

"নবী (স.)-এর কবরের কাছে যাও এবং কবরের ঘরের ছাদে একটি ছিদ্র তৈরি কর, যাতে আকাশ দেখা যায়, তারপর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা কর।" তারা তার নির্দেশ অনুসরণ করে ছাদে একটি ছিদ্র তৈরি করে যাতে আকাশ দেখা যায়। এরপর প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়, এমনকি কিছু সময় পর মরুভূমি সবুজ হয়ে ওঠে এবং উটগুলো মোটাতাজা ও হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে ওঠে।[২৭]

২. অন্ধ ব্যক্তির নবী (স.)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তার মুসনাদ-এ উসমান ইবনে হুনাইফ থেকে বর্ণনা করেছেন[২৮][২৯][৩০][৩১]: "এক অন্ধ ব্যক্তি নবী করিম (স.)-এর কাছে এসে বললেন: 'আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাকে সুস্থ করে দেন।' মহানবী (স.) বললেন: 'যদি চাও, আমি তোমার জন্য দোয়া করব, আর যদি চাও বিলম্ব করব, কারণ এটিই তোমার জন্য উত্তম।' অন্ধ ব্যক্তি বললেন: 'আমার জন্য দোয়া করুন।' তখন নবী (স.) তাকে সঠিকভাবে ও মনযোগ সহকারে ওযু করে দুই রাকাত নামায আদায় করার নির্দেশ দেওয়ার পর এই দোয়াটি পাঠ করতে বললেন:

হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি এবং রহমতের নবী মুহাম্মাদ (স.)-এর ওয়াসিলা দিয়ে তোমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। হে মুহাম্মাদ! আমি আমার রবের দিকে তোমার ওয়াসিলা দিয়ে মনোনিবেশ করছি যেন আমার চাহিদা পূরণ হয়। হে আল্লাহ! আমার জন্য তার শাফায়াত কবুল করুন।

৩. উমর ইবনে খাত্তাব কর্তৃক তাওয়াসসুল

আনাস বর্ণনা করেছেন[৩২]: «ان عمر بن الخطاب کان اذا قحطوا استسقی بالعباس بن عبدالمطلب، فقال: اللهم انا کنا نتوسل الیک بنبینا فتسقینا، و انا نتوسل الیک بعم نبینا فاسقنا، قال: فیسقون؛ যখন খরা দেখা দিত, উমর ইবনে খাত্তাব মহানবী (স.) এর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এর ওসিলা দিয়ে বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন। তিনি বলতেন: "হে আল্লাহ! আমরা আমাদের মহানবী (স.) বেঁচে থাকাকালীন সময়ে আমরা তাঁর শরণাপন্ন হতাম এবং তাঁর মাধ্যমে তোমার কাছে বৃষ্টি চাইতাম, আর তুমি আমাদের জন্য তোমার রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করতে। আজ এখন তোমার নবীর (স.) চাচার শরণাপন্ন হয়েছি, যাতে আমাদের বৃষ্টির চাহিদা পূরণ কর, আর তখন তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হতো।"».

৪. ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য নবী করিম (স.)-এর দোয়া

অন্য রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে [৩৩][৩৪][৩৫]: "যখন ফাতিমা বিনতে আসাদ ইন্তেকাল করেন, তখন আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তাঁর পাশে বসে বললেন: ‘হে আমার মা, আমার নিজের মায়ের পর! আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করুন।’ এরপর, তিনি উসামা, আবু আইয়ুব, উমর ইবনে খাত্তাব এবং এক হাবাশি কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসকে তাঁর কবর প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। যখন কবর প্রস্তুত হলো, মহানবী (স.) নিজেই সেখানে প্রবেশ করলেন, মাটির কিছু অংশ সরিয়ে দিলেন এবং কবরের মধ্যে পাজরের উপর ভর করে শুয়ে পড়লেন। এরপর তিনি এই দোয়া করলেন:

‘হে আমার আল্লাহ (যিনি জীবন্ত করেন এবং মৃত্যু দান করেন, যিনি জীবিত এবং কখনও মৃত্যুবরণ করেন না)! আমার মা ফাতিমা বিনতে আসাদকে, আপনার নবী এবং আমার পূর্ববর্তী নবীদের মর্যাদার ওসিলায় ক্ষমা করুন এবং তাঁর বিশ্রামের স্থানকে প্রশস্ত ও প্রশান্ত করে দিন।’"

৫. হযরত আদম (আ.)-এর তওবা

আহলে সুন্নতের এক দল মুফাসসির, হাদিস বর্ণনাকারী ও ইতিহাসবিদ ওমর উমর ইবনে খাত্তাবের সনদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (স.)[৩৬][৩৭][৩৮]:

"যখন আদম (আ.) ভুল করেছিলেন, তখন তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন: ‘হে আমার আল্লাহ, আমি তোমার কাছে মুহাম্মাদের মর্যাদার ওসিলায় ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ তখন আল্লাহ তার প্রতি ওহি প্রেরণ করলেন: "মুহাম্মাদ কে? " হযরত আদম (আ.) উত্তর দিলেন: ‘যখন তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছিলে, তখন আমি তোমার আরশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে লেখা রয়েছে: "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।" তখন আমি নিজেকেই বললাম যে, মুহাম্মাদ তোমার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, কারণ তুমি তার নাম তোমার নামের পাশে রেখেছ।’ এ সময় আল্লাহ ওহি পাঠালেন: "সে তোমার বংশধরদের মধ্যে সর্বশেষ নবী, আর সে যদি না হতো, তাহলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।"

তথ্যসূত্র

  1. ফারাহিদি, খালিল বিন আহমাদ (১৪০৯ হি.). কিতাবুল আইন, খ:১, মুআসসাসাতু দারুল হিজরাহ, পৃ:৮৭১।
  2. আবুল আব্বাস ফিউমি, আহমাদ বিন মোহাম্মদ (১৪২৮ হি.). আল-মিসবাহুল মুনির, খ:২, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, পৃ:৬৬০।
  3. ইবন মানজুর, মোহাম্মদ বিন মাকরাম (১৪০৮ হি.). লিসানুল আরব, খ:১১, দার ইহইয়াউত তুরাসিল আরবি, পৃ:৭২৪।
  4. নির্বাচিত পণ্ডিতদের একটি দল (১৪২১ হি.). উসুলুল ঈমান ফি দউইল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, খ:১, ওয়ারাযাতুশ শুউনুল ইসলামিয়্যাহ ওয়াল আওকাফ ওয়াদ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, পৃ:৫৭।
  5. সায়েব, আব্দুল হামিদ (১৪২১ হি.). আল-জিয়ারাহ ওয়াত তাওয়াসসুল, কুম: মারকাজুর রিসালাহ, পৃ:৬।
  6. ইবন আসীর জাজরি, মুবারক বিন মোহাম্মদ (১৯৭৯). আন-নিহায়াহ ফি গারিবিল হাদিস ওয়াল আসার, খ:৩, বৈরুত: আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়্যাহ, পৃ:৩৯৩।
  7. বুখারি, মোহাম্মদ বিন ইসমাইল (১৪০৭ হি.). আল-জামেউস সহিহ, খ:৫, বৈরুত: দারুল কাসির, পৃ:৪৭৪।
  8. সমহুদী, আলী বিন আবদুল্লাহ (১৪১৯ হি.). ওয়াফাউল ওয়াফা বিআখবারি দারিল মুস্তাফা, খ:১, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, পৃ:১৯৬।
  9. আজ-জামিলি আসিরি, আহমাদ বিন আলী (১৪৩১ হি.). মানহাজুশ শাইখ আবদুর রাজ্জাক আফিফি ওয়া জুহুদুহু ফি তাকরিরিল আকিদাহ ওয়ার রদ্দু আলাল মুখালিফিন, গবেষণা ও সম্পাদনা: আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মোহসিন আত-তুরকি, রিয়াদ: জামিয়াতুল ইমাম মোহাম্মদ বিন সৌদ আল-ইসলামিয়া, পৃ:২৭৬।
  10. মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, মাজমুয়াতুল মুআল্লাফাত, পৃ:৩৮৫।
  11. মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, মাজমুয়াতুল মুআল্লাফাত, খ:৬, পৃ:৯।
  12. মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, মাজমুয়াতুল মুআল্লাফাত, খ:৬, পৃ:৬৮।
  13. মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, মাজমুয়াতুল মুআল্লাফাত, খ:৬, পৃ:২১৩।
  14. আল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ লিল বুহুসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা, ফাতাওয়াল লাজনাহ আদ-দাইমাহ, আল-মাজমুআতুল উলা, সৌদি আরব, রিয়াদ, রিয়াসাতু ইদারাতিল বুহুসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা, তাছহিহ ও সম্পাদনা: আহমাদ বিন আব্দুর রাজ্জাক আদ-দাওয়াইশ, খ:১, পৃ:৫১৯।
  15. মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, তাথহিরুল ইতিকাদ, অনুল্লিখিত, অনুল্লিখিত, পৃ:৩৬; রাসাইল আমালিয়্যাহ, অনুল্লিখিত, অনুল্লিখিত, পৃ:১৪৫।
  16. মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, তাথহিরুল ইতিকাদ, পৃ:৩৬।
  17. আসিরি, আহমাদ বিন আলী আজ-জামিলি, মানহাজুশ শাইখ আবদুর রাজ্জাক আফিফি ওয়া জুহুদুহু ফি তাকরিরিল আকিদাহ ওয়ার রদ্দু আলাল মুখালিফিন, পৃ:২৭৪-২৭৭।
  18. সুলাইমান আত-তামিমি নাজদি, মোহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব, মাজমুয়াতু রাসাইল ফিত তাওহিদ ওয়াল ঈমান, গবেষণা: ইসমাইল বিন মোহাম্মদ আল-আনসারি, রিয়াদ: জামিয়াতুল ইমাম মোহাম্মদ বিন সৌদ, পৃ:৩৮৫।
  19. সালামি, আব্দুর রহমান (১৪১৫ হি.). হাকিকাতুল হিওয়ার মা'আ আশ-শাইখ আল-জাফারি, সৌদি আরব: আদ-দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদ, পৃ: ৮৫।
  20. সাকাফ আল-কুরাইশি, হাসান বিন আলী (১৯৯১). সহীহ শারহুল আকিদাতুত তাহাওয়িয়াহ মিন ফিকরি আলুল বাইত, পৃ: ৩৬।
  21. নুবমানি, ইউসুফ বিন ইসমাইল. শাওয়াহিদুল হক ফিল ইস্তিগাসাহ বিসাইয়িদিল খালক, সম্পাদনা: অফিসেট/হুসাইন হিলমি বিন সাইদ ইস্তাম্বুলি, পৃ: ১৬৭।
  22. ইবন মানজুর, মোহাম্মদ বিন মাকরাম. লিসানুল আরব, খ: ৮, নাশর আদবুল হাওযাহ, পৃ: ৬৯।
  23. মাকারেম শিরাজি, নাসের. শিয়া পাশুখ মিগুয়াদ, কুম, মাদরাসাতুল ইমাম আলী বিন আবি তালিব (আ.), পৃ: ২৩৩।
  24. মাকারেম শিরাজি, নাসের. শিয়া পাশুখ মিগুয়াদ, কুম, মাদরাসাতুল ইমাম আলী বিন আবি তালিব (আ.), পৃ: ২৩৪।
  25. মুনাওয়ী, আবদুর রউফ (১৩৫৬ হি.). ফাইযুল কাদির শারহু জামিউস সগীর, খ: ২, মিসর: আল-মাকতাবাতুত তিজারিয়্যাহ আল-কুবরা, পৃ: ১৩৫।
  26. মারাগী, আহমদ বিন মুস্তফা. তাফসিরুল মারাগী, খ: ৬, পৃ: ১০৯।
  27. দারেমি, আবদুল্লাহ বিন বাহরাম. সুনান দারেমি, খ: ১, পৃ: ৪৪, মাটবাআতুল ই'তিদাল, দামেস্ক, ১৩৪৯ হি।
  28. ইবন হাম্বল, আহমদ বিন হাম্বল. "হিকায়াত ১৭২৪০", আল-মুসনাদ, খ: ২৮, পৃ: ৪৭৮।
  29. নাসাঈ, আহমদ বিন শুয়াইব. "হিকায়াত ১০৪১৯", সুনান আন-নাসাঈ আল-কুবরা, খ: ৯, পৃ: ২৪৪।
  30. ইবন মাজাহ কুজুইনি, মোহাম্মদ বিন ইয়াজিদ. "কিতাবুস সালাত, বাব ১৮৯, হাদিস ১৩৮৫", সুনান ইবন মাজাহ, পৃ: ৪৪১।
  31. তিরমিজি, আবু ঈসা. "কিতাবুদ দাওয়াত, বাব ১১৯, হাদিস ৩৫৭৮", সুনান আত-তিরমিজি, খ: ৫, পৃ: ৫৬৯।
  32. বুখারি, মোহাম্মদ বিন ইসমাইল. "কিতাবুল ইস্তিসকা, বাব ৩, হাদিস ১০১০", সহীহুল বুখারি, খ: ২, পৃ: ২৭।
  33. আসফাহানি, আহমদ বিন আবদুল্লাহ. হিলইয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, খ: ৩, পৃ: ১২১।
  34. তাবারানী, সুলাইমান বিন আহমাদ. "বাবুল ফা", আল-মুজামুল কবির, খ: ২৪, পৃ: ৩৫১।
  35. হাইসামি, আলী বিন আবু বকর (১৪০৮ হি.). মাজমাউজ জাওয়ায়েদ ওয়া মাআদিনুল ফাওয়ায়েদ, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, পৃ: ২৫৭।
  36. বলেছেন মুতকী হিন্দি, আলী বিন হুসাম. "হিকায়াত ৩২১৩৮", কানযুল উম্মাল, খ: ১১, পৃ: ৪৫৫।
  37. হাইসামি, আলী বিন আবু বকর. মাজমাউজ জাওয়ায়েদ ওয়া মাআদিনুল ফাওয়ায়েদ, খ: ৮, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, পৃ: ২৫৩।
  38. তাবারানী, সুলাইমান বিন আহমাদ. "হিকায়াত ৬৫০২", আল-মুজামুল আওসাত, খ: ৬, পৃ: ৩১৩।

টেমপ্লেট:ارزیابی