ইসলামি সমাজে তাকফিরের সূচনা
মুসলমানদের মধ্যে তাকফির করা কবে থেকে এবং কীসের ওপর ভিত্তি করে সূচনা হয়?
ইসলামি সমাজে তাকফিরের অর্থ হলো এমন ব্যক্তিকে কুফরির অভিযোগে অভিযুক্ত করা বা কাফির ঘোষণা করা, যে ইসলাম ও ইমানের দাবি করে থাকে। এই ঘটনা যেমন ব্যক্তি পর্যায়ে ঘটতে পারে, তেমনি কোন মতবাদ বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তবে যা সবচেয়ে বিপজ্জনক তা হলো তাকফিরি চিন্তাধারা, যেখানে নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক নীতির ভিত্তিতে মুসলমানদের তাকফির করা হয়; যেমন, খারিজি সম্প্রদায় মুসলমানদেরকে কবিরা গোনাহের ভিত্তিতে তাকফির করে। সালাফি ও ওহাবিরা কবর জিয়ারত, শাফায়াতে বিশ্বাস, তাবারুক ও অন্যান্য বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তাকফির করে থাকে।
ব্যক্তি পর্যায়ে তাকফির
এই ধরনের তাকফির, যা সাধারণত কোনো কারণ ছাড়াই শুধু শত্রুতা ও বিদ্বেষের ভিত্তিতে হয়ে থাকে, যেখানে একজন মুসলিম অন্য একজন মুসলিমকে তাকফির করে এবং তাকে কাফির বলে দোষারোপ করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, এমনকি মহানবির (সা.) জীবদ্দশায় [তথ্যসূত্রের প্রয়োজন] এবং তার পরবর্তীতে খলিফদের সময়েও কতিপয় মুসলমান অন্যদের দ্বারা তাকফির হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ, আবু বকরের খিলাফতকালে, মালিক ইবনে নুওয়াইরা এবং তার গোত্রকে যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতির অভিযোগে তাকফির করা হয়েছিল এবং খালিদ ইবন ওয়ালিদ কর্তৃক তারা সবাই গণহত্যার শিকার হয়।[১] কিন্তু এই ধরনের তাকফির করাকে ব্যক্তিগত ও ব্যক্তি পর্যায়ের তাকফির হিসাব করা হয়ে থাকে এবং এগুলোকে তাকফিরি চিন্তাধারা বলা যায় না।
তাকফিরি চিন্তাধারা ও গোষ্ঠীসমূহ
ইসলামি বিশ্ব বর্তমানে তকফিরি চিন্তাধারার মতো একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন যা মূলত মাজহাব ও ফেরকা রূপধারণ করে মুসলমানদের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই তকফিরি চিন্তাধারাগুলোর পরিক্রমা ও বিবর্তন রয়েছে, যেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করা হল:
খারিজি তাকফিরি চিন্তাধারা
তকফিরি চিন্তা একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। খারিজি সম্প্রদায় হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্ট সর্বপ্রথম তাকফিরি চিন্তাধারার অনুসারী। আরবিতে এদেরকে খাওয়ারিজ (خوارج) বলা হয় যা খারিজি (خارجی) শব্দের বহুবচন। যা শব্দমূল খুরুজ (خروج) থেকে গৃহীত হয়েছে; যার অর্থ বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা।[২]
খারিজি সম্প্রদায় ৩৭ হিজরিতে হজরত আলী (আ.) ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধের মধ্যস্থতার পর উদ্ভব হয়।[৩] এই সম্প্রদায়ের অনুসারীরা ছিল হজরত আলী (আ.) -এর কতিপয় সৈন্য, যারা শুরুতে মুয়াবিয়া এবং আমর আসের মাধ্যমে প্রতারিত হয় এবং মুয়াবিয়ার পক্ষে মধ্যস্থতার প্রস্তাবে সম্মতি দেয় এবং ইমাম আলী (আ.) -কে এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য করে। কিন্তু মধ্যস্থতার রায় ঘোষণার পরক্ষণেই তারা তাদের ভুল বুঝতে সক্ষম হয় এবং নিজেদের কাঁধে দোষ না নিয়ে এবং ইমাম আলীর (আ.) নিকট ক্ষমা না চেয়ে বরং তারা আরও বড় অন্যায় করে এবং আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ মানিনা (لا حکم الا لله) স্লোগান দিতে শুরু করে।[৪] অতঃপর তারা মধ্যস্থতাকে ভিত্তিহীন, আল্লাহর আদেশ পরিপন্থি এবং শিরক ও কুফরির কারণ হিসেবে ঘোষণা দেয়।[৫] তারা ইমাম আলী (আ.) -কে তাঁর কৃতকর্মের জন্য তওবা করতে বলে এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে মুয়াবিয়ার সাথে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করতে বলে।[৬]
ইমাম আলী (আ.) তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান এবং স্মরণ করিয়ে দেন যে, মধ্যস্থতার ব্যাপারে তাদের ধারণা ভুল; কেননা মধ্যস্থতা কোন ব্যক্তির সাথে নয় বরং মধ্যস্থতা কুরআন শরীফের সাথে হয়েছে এবং আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, যে বিবাদে আল্লাহ ও তাঁর নবীর (সা.) শরণাপন্ন হওয়া উচিত।[৭] কুরআনের শরণাপন্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে তার আদেশ মেনে চলা আর নবীর শরণাপন্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁর সুন্নতের উপর আমল করা। যখনি কুরআন ও নবিজির সুন্নাত মোতাবেক বিচার হবে, তখন হক (ন্যায়) আমাদের পক্ষেই থাকবে।[৮]
কবিরা গোনাহ করলে যে কাউকে খারিজিরা কাফের মনে করে। খারিজিদের পর, শিয়াদেরকে বনি উমাইয়্যা কাফের ঘোষণা করে এবং এই অভিযোগে অনেক শিয়া গণহত্যার শিকার হয়।
বারবাহারি তাকফিরি চিন্তাধারা
হিজরি চতুর্থ শতকে হাম্বালি মাজহাবের প্রসিদ্ধ আলেম আবু মুহাম্মাদ বারবাহারি কবর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ করে, যা আব্বাসীয় খলিফার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। বলা হয়ে থাকে এই চতুর্থ শতকেই, ইবনে বাত্তা নামে প্রসিদ্ধ আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ আবকারি হাম্বালিও (মৃত্যু: ৩৭৮ হি.) জিয়ারত ও নবীর শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নবীর কবর জিয়ারতের সফরকে গোনাহের সফর হিসেবে মনে করে।[৯]
বারবাহারি তাদেরকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন যারা তার মতে বিদাতের অনুসারী ছিল এবং এর ভিত্তিতে সে নিজের বিরোধীদেরকে তাকফির করে। তাদের দমন করার জন্য একটি দল গঠন করে। এই কাজের ফলে আব্বাসিয় খলিফা আল-কাহের বিল্লাহ তার ওপর ক্রুদ্ধ হয় এবং পরিণতিতে তাকে বসরায় নির্বাসিত করা হয়। আল-রাযি বিল্লাহর সময় বারবাহারি সম্প্রদায়ের ফিতনা (বিগ্রহ) বৃদ্ধি পায় এবং এই কারণে আব্বাসিয় খলিফা নির্দেশে, শহরে ঐ সম্প্রদায়ের দু'জন লোকেরও একত্রিত হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আব্বাসিয় শাসনের এই কঠোর পদক্ষেপের ফলে, বারবাহারি একটি স্থানে আত্মগোপন করে এবং সেখানেই মারা যায়।[১০] বাগদাদে, অনেক বারবাহারি সদস্যকে বন্দী করা হয় এবং অনেকেই আত্মগোপন করে অথবা অন্যান্য শহরে পালিয়ে যায়।[১১]
ইবনে তাইমিয়্যা বারবাহারি চিন্তাধারার পুনর্জীবিতকারী
আব্বাসীয় খলিফাদের দ্বারা বারবাহারি চিন্তাধারা দমনের পর, হিজরি সপ্তম শতকে ইবনে তাইমিয়্যা নামে প্রসিদ্ধ আহমাদ ইবনে আব্দুল হালীম হারানী (জন্ম ৬৬১ হিজরি)[১২], বারবাহারি চিন্তাধারাকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং মুসলমানদেরকে জিয়ারত, তাওয়াসসুল, শাফাআত এবং তাবারুকের প্রতি বিশ্বাসের কারণে তাকফির করে। ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রকৃতপক্ষে ওহাবি বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নবি (সা.) এবং অন্যান্য আওলিয়াদের জিয়ারাত এবং তাদের নিকট শাফাআত চাওয়াকে হারাম মনেকরা বিশেষ আকিদাকে তওহিদ ও শিরকের উপর লিখিত বহু গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে সংকলন করেন।
ইবনে তাইমিয়্যার সৃষ্ট অদ্ভুত চিন্তাধারা ও দর্শনের বিপরীতে, সমসাময়িক এবং পরবর্তী যুগের শিয়া ও সুন্নি মাজহাবের বুজুর্গ আলেমগণ তার আকিদার বিরুদ্ধে অসংখ্য বই লিখেছেন।[১৩]
মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব, ইবনে তাইমিয়্যার চিন্তাধারার পুনর্জীবিতকারী
ইবনে তাইমিয়্যার পরবর্তীতে ইসলামি বিশ্বে তাকফিরি চিন্তাধারা খুব বেশি প্রকাশ পায়নি। হিজরি দ্বাদশ শতকে মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব এই চিন্তাধারাকে পুনরায় জীবিত করে। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব বিন সুলাইমান তামিমি হিজরি ১১১১ মতান্তরে হিজরি ১১১৫ সনে (১৭০৩ বা ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দ) নাজদের “আইনা” শহরে জন্মগ্রহণ করে।[১৪]
ওহাবিদের নেতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব, ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এতটাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন যে, তিনি চরমভাবে বলেন, মুসলমানদের শিরক জাহিলিয়াতের যুগের মূর্তিপূজকদের শিরক থেকে বেশি গুরুতর; কেননা মুশরিকরা শুধু সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য শিরকে লিপ্ত হত এবং কঠিন সময় বা বিপদের সময়ে তারা একেশ্বরবাদী তথা আল্লাহর উপাসক হয়ে যেত; কিন্তু মুসলমানেরা উভয় অবস্থাতে (কঠিন ও সহজ) মুশরিক।[১৫] তিনি বলেন, কেউ যদি মুশরিকদের (মুসলমানদের) কাফের না বলে অথবা তাদের কুফরির বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে, তবে তা হবে ইসলামের অন্যতম অপূরণীয় ক্ষতির প্রধান কারণ।[১৬] কানুজি এই বিষয়ে বলে, আমাদের সময়ে, নাজদ থেকে উঠে আসা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাবের সমস্ত অনুসারী হারামাইনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং নিজেদেরকে হাম্বলি মাযহাবের অনুসারী দাবি করত। তারা বিশ্বাস করত যে, শুধু তারাই মুসলমান এবং তাদের বাইরে বাকি সবাই মুশরিক। এই স্লোগান দ্বারা তারা আহলে সুন্নাহ ও তাদের আলেমদের হত্যাকে বৈধ মনে করত।[১৭] এই চিন্তাধারাকে সালাফি তাকফিরি বলা হয়।
এই ধরনের সালাফিরা তাদের বিরোধীদের কাফের মনে করে। বর্তমান যুগে, ওহাবিয়াত সালাফি তাকফিরির দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়; কারণ ওহাবিদের দৃষ্টিতে, সমস্ত মুসলমান কোন না কোন ধর্মীয় রীতি পালনের কারণে মুশরিকের কাতারে অবস্থান করছে এবং তাদের দৃষ্টিতে এরা (مهدورالدم) মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। এই কারণেই ওহাবিদের সবগুলো যুদ্ধ শুধু মুসলমানদের সাথে হয়েছে।[১৮] বর্তমান সময়ে, সমস্ত তাকফিরি গোষ্ঠী ওহাবি মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত এবং তারা সবাই সালাফি তাকফিরি চিন্তাধারার অনুসারী, যারা মুসলমানদের রক্তপাত করে থাকে এবং ইসলামের শত্রুদের সেবায় নিয়োজিত থাকে।
তথ্যসূত্র
- ↑ তাবারী, আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন জারীর, তারিখ আল-তাবারী, বৈরুত, দার আল-কিতাব আল-উলামিয়া, বেটা, ভলিউম ২, পৃ. ২৭২-২৭৩।
- ↑ হাওজি শেরনউমি, সাইদ, আকরাব আল-মাওদার, বৈরুত, মুরসালি ইলিসুইয়েহ প্রেস, ১৮৮৯, পৃষ্ঠা ২৬৪।
- ↑ দিনৌরি, আখবার আল-ত্বাল, মাহমুদ মেহেদী দামঘনি, তেহরান, নি পাবলিশিং হাউস, চ. ৪, ১৩৭১, পৃ.
- ↑ দিনৌরী, আখবার আল-ত্বাল, পৃ.
- ↑ দিনৌরী, আখবার আল-ত্বাল, পৃ. ২৪৭।
- ↑ দিনৌরী, আখবার আল-ত্বাল, পৃ. ২৫২।
- ↑ নিসা, ৫৯।
- ↑ ফয়েজ আল-ইসলাম, নাহজ আল-বালাঘা, পৃ. ৩৮৬, খুতবা ১২৫।
- ↑ ফকিহী, আলী আসগর, ওয়াহাবিয়ান, ইসমাইলিয়ান পাবলিকেশন্স, ভলিউম ২, ১৩৬৪, পৃ. ১৯ এবং ২০।
- ↑ জারকালি, খাইর আল-আলম, ২০১, বৈরুত, দার আল-আলম লালমলায়ন, ৫, ১৯৮০।
- ↑ ইবন আল-জাওযী, আল-মুন্তাজেম ফি তারিখ আল-উনহুহ আল-মালুক, ১৩, পৃ. ২৪৯, বৈরুত, ১৪১২হি/১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ। গবেষণাঃ মোহাম্মদ আব্দুল কাদের আত্তা ও মোস্তফা আব্দুল কাদের আত্তা।
- ↑ কাথিরি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ, আল-সালাফিয়্যাহ বিন আল-মামিয়্যাহ, পৃঃ ২১১, বৈরুত, গাদির পাবলিকেশন্স, ১, ১৪১৮ হি।
- ↑ কাথিরি, সৈয়দ মুহাম্মাদ, আল-সালাফিয়া সুন্নাহ এবং আল-আমামিয়া, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৯, বৈরুত, গাদির পাবলিকেশন্স, ১, ১৪১৮ হিজরি।
- ↑ সোবহানী, জাফর, বিশ্ব এবং আল-নাহল, খণ্ড 334, ইসলামিক প্রকাশনা ইনস্টিটিউট, ৩, ১৪১৪ হি।
- ↑ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব আযীযুল-আযমা, পৃ. ১২১; মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, কাশফ আল-শাবাত, পৃষ্ঠা 33 এবং 34, রিয়াদ, ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ৬, ১৪২০হিজরি।
- ↑ আবদ আল-হালিম উবাইস, আল-দাওয়া আলী মানহাজ আল-নবওয়াহ (এথর আল-তাজদীদ ফি আল-আলজিয়ার্স), পৃ. ১৩৫, রিয়াদ, ১৪২৩হি।
- ↑ কানোজি, সেদিক বিন হাসান, আবজদাল উলূম, ৩/১৯৮, দার আল-কুতব আল-উলামিয়া, ১৯৯৮, ইবনে আবেদিনের মার্জিন থেকে উদ্ধৃত।
- ↑ আলীজাদেহ মুসাভি, সাইয়্যেদ মেহেদী, সালাফিবাদ এবং ওয়াহাবিজম (বংশলিপি), ভলিউম ১ পৃ. ৯৪-৯৫, কওম, কওম সেমিনারির ইসলাম প্রচার অফিস, সংস্কৃতির ভাইস-চ্যান্সেলর।