অহংকার

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

আত্ম অহংকার বলতে কি বোঝায়? অহংকার কি?

অহমিকা বা আত্ম-অহংকার হলো নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় মনে করা এবং কথাবার্তা বা আচরণের মাধ্যমে অন্যেকে হেয় করে দেখা।

অপমান বোধ, আত্ম-সম্মান বোধের কমতি এবং মানুষের উপর শয়তানের আধিপত্য অহংকারের অন্যতম কারণ সমূহ হিসেবে বিবেচিত হয়। আত্ম অহংকার দূরীকরণে ব্যক্তিত্ব বোধ, মৃত্যুর স্বরণ এবং আত্মসম্মান বোধ বৃদ্ধির ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

অহংকার কখনো স্বয়ং আল্লাহর ক্ষেত্রে, যা সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অহংকার হিসেবে ধরা হয়েছে। আবার অহংকার কখনো নবী রাসুল এবং আল্লাহর উত্তম বান্দাদের ব্যাপারে ও পরিলক্ষিত হয়, এমনভাবে যে অহংকারী ব্যক্তি তাঁদের চেয়ে ও নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং তাদের আনুগত্য করাকে যথোপযুক্ত মনে করে না।

পরিভাষা পরিচিতি

"অহংকার" হলো অন্যের তুলনায় নিজেকে বড় মনে করা।[১] এবং "অহংকারী" হলো প্রকাশ্যে কথাবার্তায় এবং আচরণের মাধ্যমে তা স্পষ্ট করা। যতক্ষণ অবধি নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় করে দেখা শুধু অন্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং তা প্রকাশ না করে তা অহংকার বলে গণ্য হয়। এবং যখন ব্যক্তি তার অন্তরের ধারণা কে বাস্তবায়ন করে এবং তা নিজের কথাবার্তা এবং আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় সে অহংকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়।[২]

ফার্সি ভাষায় দুইটি শব্দ "দাম্ভিকতা" এবং "অহংকার" সমার্থক শব্দ এবং তা একই অর্থ প্রদান করে। যদিও "দাম্ভিকতা" শব্দটি আরাবী ভাষায় ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং তা অহংকার শব্দার্থ হতে ভিন্ন।

স্বার্থপরতার সাথে পার্থক্য

স্বার্থপর এবং গর্বকারী অর্থাৎ স্ব-ধার্মিকতা।[৩] এমন ব্যক্তি যে নিজেকে বড় মনে করে[৪]; কিন্তু অন্যের চেয়ে উত্তম মনে করে না। এমনটি নয়, যেভাবে একজন অহংকারী নিজেকে বড় মনে করে এবং অন্যদের নিজের তুলনায় ছোট মনে করে।[৫]

আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে অহংকারের পার্থক্য

আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে অহংকারের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য তার উৎপত্তি গত পার্থক্যের কারণে; আল্লাহর অহংকারের মূল হলো জ্ঞান, শক্তি ও তার প্রজ্ঞা; কিন্তু মানুষের অহংকারের উৎস হলো উৎসাহী অনুভূতি, অজ্ঞতা এবং দূর্বল ইচ্ছাশক্তির বহিঃপ্রকাশ।

ইমাম সাদিক (আ:) এর বর্ণনা অনুসারে:

মানুষের ভিতর অহংকার সৃষ্টির কারণ হলো সে নিজের মধ্যে হীনতা এবং অপমান অনুভব করে। তখন নিজের দোষ-ক্রুটি কে গোপন করার চেষ্টা করে[৬]; এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাবে এমন অবস্থান দাবি করে যা তার যোগ্যতার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে না।

অবস্থান

পবিত্র কোরআনে অহংকার এবং অহংকারী ব্যক্তির ব্যপারে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতে উদাহরণ স্বরূপ, ﴾کَذٰلِکَ یَطْبَعُ اللَّهُ عَلَیٰ کُلِّ قَلْبِ مُتَکَبِّرٍ جَبَّار এইভাবে আল্লাহ মোহর মেরে দেন, প্রত্যেক অহংকারী ও অত্যাচারীর অন্তরে।﴿(গাফির:৩৫) উক্ত আয়াতে অহংকারী ব্যক্তির ব্যপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা বাকারার ৩৪ নম্বর আয়াতেও ইবলিসের দাম্ভিকতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যখন মহান আল্লাহ হযরত আদমকে ( আ:) সেজদা করতে আদেশ করেছিলেন। অহংকার কে দুনিয়ার সর্বপ্রথম পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ইমাম আলী (আ:) তার কাসিয়া নামক খুতবায় বর্ণনা করেছেন' ইবলিসের দাম্ভিকতা তার ছয় হাজার বছরের ইবাদত ধ্বংসের কারণ হয়েছিল।[৭] অপর আরেক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে: অহংকার কে সবচেয়ে বড় গুনাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৮]

প্রকারভেদ

অহংকারের কিছু প্রকারভেদ রয়েছে।

  • আল্লাহর প্রতি অহংকার: কখনও কখনও আল্লাহর প্রতি ও অহংকার দেখা যায়।[৯] এ অর্থে যে একজন মানুষ আল্লাহর আনুগত্য কে স্বীকার করেনা এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য বিশেষ বলে গণ্য করে না। যেমনভাবে ফেরাউননমরুদ দাম্ভিকতা প্রকাশ করত। এই দাম্ভিকতার কারণ হল অজ্ঞতা এবং বিদ্রোহ, এবং একে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অহংকার বলা হয়েছে।[১০]
  • নবী রাসুল ও আল্লাহর আউলিয়া দের প্রতি অহংকার: কখনও কখনও নবীআউলিয়া দের প্রতি অহংকার এমনভাবে হয় যে, একজন ব্যক্তি নিজেকে তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং তাদের আনুগত্য করে না। আয়াতে বলা হয়েছে; فَقَالُوا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَیْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُون؛ এমন দুজন মানুষ যারা আমাদের মতই, তাদের প্রতি ঈমান আনবো? ( সূরা মু'মিনুন ৪৭ নং আয়াত) এ ধরনের অহংকারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
  • আল্লাহর বান্দাদের প্রতি অহংকার: কখনও কখনও আল্লাহর মুমিন বান্দাদের প্রতিও অহংকার পরিলক্ষিত হয়। এরুপ অর্থে যে একজন ব্যক্তি নিজেকে উচ্চ মনে করে ও অপরকে তাচ্ছিল্য করে। এই ধরনের অহংকার, যা আল্লাহর সাথে বিরোধিতার দিকে পরিচালিত করে এবং তা মানুষের ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্য সমূহের কারণ ভুক্ত হয়।

কারণ সমূহ

অহংকারের অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যক্তিত্ব হীনতা, নিজের দূর্বলতার প্রতি অজ্ঞতা এবং নাফসের প্রতি শয়তানের আধিপত্যের ব্যপারে উল্লেখ করা হয়েছে।[১১] অপমান,আত্ম-সম্মান বোধ ও ব্যক্তিত্বের অনুপস্থিতি একজন মানুষকে অহংকারী করে তোলে।[১২]

মুক্তির উপায়

অহংকার দূরীকরণে কয়েকটি উপায় উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো;

নিজের দূর্বলতার প্রতি অবগত থাকা, বিশেষ করে তার জন্ম এবং মৃত্যুর সময়ের পরিস্থিতির প্রতি, ইহা মানুষের অহংকারকে বিলীন করে দেয়।[১৭] একইসাথে আল্লাহর নিকটে নম্রতার সহিত ইবাদতও অহংকারকে দূর্বল করে দেয়।[১৮]

দাম্ভিকতার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো নিজের প্রতি হীনমন্যতা, যা থেকে মুক্তির জন্য ব্যক্তিত্বতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

নারীদের জন্য অহংকারের বিধান

ইমাম আলী (আ:) এর বর্ণনা অনুসারে, নন-মাহরামের বিরুদ্ধে নারীর অহংকার উত্তম বলে বিবেচিত হয়। এই দলিলের ভিত্তিতে যে, নন-মাহরামের মোকাবেলায় একজন নারীর সন্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখে এবং সম্ভাব্য বিপদ হতে নিশ্চয়তা বজায় থাকে। নারীর অহংকার বলতে নন-মাহরাম কে হেয় করা নয়; বরং নারী তার প্রতি অহংকার প্রদর্শন করে তার অসৎ উদ্দেশ্যের বস্তু হওয়া থেকে নিজেকে হেফাজত করে।[১৯] অহংকার " অন্যকে হেয় চোখে দেখা" অর্থ হলে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই তা অনুমোদিত নয় এবং সেটি গোনাহের কারণ বলে বিবেচিত হয়।

তথ্যসূত্র

  1. রাগীব ইসফাহানি, আল-মুফরাদাত ফি গারিব আল-কোরআন, তেহরান, প্রকাশকাল ১৪০৪হি:, পৃ: ৪২১ও ৪২২; ইলমে আখলাকে ইসলামী, অনুবাদে জামেয় আল-সায়াদাত , হিকমাত প্রকাশনা, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৬৩ ফার্সি সন, প্রথম খন্ড, পৃ:৪১৭।
  2. নারাকী,মোল্লা আহমদ, মেরাজ আল-সায়াদাহ,মাশহাদ, ইসলামী নেদা প্রকাশনা, প্রথম সংস্করণ, ১৩৬২ ফার্সি সন, পৃ: ১৭৬।
  3. ইমাম খোমেনী, সাইয়েদ রুহুল্লাহ, চল্লিশ হাদিসের ব্যাখ্যা, ইমাম খোমেনী প্রকাশনী সংস্থা, দ্বিতীয় সংস্করণ,১৩৭১ ফার্সি সন, পৃ:৭৯।
  4. নারাকী, মোল্লা মোহাম্মদ মাহদী, জামেয়া আল-সাদাত, সাইয়েদ মুহাম্মদ কালান্তী কর্তৃক সম্পাদিত ও সংশোধনীত, আল-নাজাফ প্রকাশনী, ইসমাইলিয়ান প্রকাশনী সংস্থা, প্রথম খন্ড, পৃ: ৩২৪,৩৫১।
  5. ইমাম খোমেনী, সাইয়েদ রুহুল্লাহ, চল্লিশ হাদিসের ব্যাখ্যা, ইমাম খোমেনী প্রকাশনী সংস্থা, দ্বিতীয় সংস্করণ,১৩৭১ ফার্সি সন, পৃ:৭৯।
  6. কুলাইনী, মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব, উসুলে কাফি, অনুবাদক ও বিশ্লেষক সাইয়েদ জাওয়াদ মুস্তাফাভি, তৃতীয় খণ্ড, অহংকার অধ্যায়।
  7. ইবনে আবিল হাদীদ, শারহে নাহজুল বালাগা, দারআহইয়া আল-কুতুব আল-আরাবিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, তেরোতম খন্ড, পৃ:১২৭।
  8. শাফিয়ী, মোহাম্মদ, চল্লিশ হাদিসের আলোকে, ইসলামী প্রচারণা সংস্থা, প্রথম সংস্করণ, ফার্সি সন ১৩৭০, প্রথম খন্ড, পৃ: ২৮০।
  9. দাসতাগীব,সাইয়েদ আব্দুল হোসাইন, কবিরা গুনাহ,আরমান প্রকাশনী,দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১১১,১৩২।
  10. রাগীব ইসফাহানি,হোসাইন, আল-মুফরাদাত ফি গারিব আল-কোরআন, তেহরান,বই প্রকাশনী,১৪০৪ হি:, পৃ.৪২১,৪২২।
  11. নারাকী,আহমাদ,মেরাজ আল-সায়াদাহ, পৃ: ১৭৮।
  12. ইলমে আখলাকে ইসলামী, অনুবাদে জামেয় আল-সায়াদাত,হিকমাত প্রকাশনা, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৬৩ ফার্সি সন, প্রথম খন্ড, পৃ:৪১৭।
  13. মজলিসী, মোহাম্মদ বাকের,বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, ৭৮ তম খন্ড, পৃ:৯৪।
  14. শাফিয়ী, মোহাম্মদ, চল্লিশ হাদিসের আলোকে,ইসলামী প্রচারণা সংস্থা, প্রথম সংস্করণ, ফার্সি সন ১৩৭০, প্রথম খন্ড, পৃ: ২৯১।
  15. শাফিয়ী, মোহাম্মদ, চল্লিশ হাদিসের আলোকে,ইসলামী প্রচারণা সংস্থা, প্রথম সংস্করণ, ফার্সি সন ১৩৭০, প্রথম খন্ড, পৃ: ২৯১।মোহাম্মদী রেই-শাহরী, মোহাম্মদ,মিজানুল হিকমাহ, দারুল হাদিস, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ:২৬৫৭, শাফিয়ী, মোহাম্মদ, চল্লিশ হাদিসের আলোকে,ইসলামী প্রচারণা সংস্থা, প্রথম সংস্করণ, ফার্সি সন ১৩৭০, প্রথম খন্ড, পৃ: ৪৯২।
  16. শাফিয়ী, মোহাম্মদ, চল্লিশ হাদিসের আলোকে,ইসলামী প্রচারণা সংস্থা,প্রথম খন্ড, পৃ: ৪৯১।
  17. মজলিসী, মোহাম্মদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, ৭৮ তম খন্ড, পৃ:৯৪।
  18. মোহাম্মদী রেই-শাহরী, মোহাম্মদ,মিজানুল হিকমাহ, দারুল হাদিস, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ:২৬৫৭, শাফিয়ী, মোহাম্মদ, চল্লিশ হাদিসের আলোকে,ইসলামী প্রচারণা সংস্থা, প্রথম সংস্করণ, ফার্সি সন ১৩৭০, প্রথম খন্ড, পৃ: ৪৯২।
  19. মোহাম্মদী রেই-শাহরী, মোহাম্মদ, মুনতাখাব আল-হিকমাহ, অনুবাদক: হামিদ রেজা শায়খী, কোম, দারুল হাদিস, ১৩৮২ ফার্সি সন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ৯১০।