আল্লাহর অসীম সত্তা

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

আল্লাহর অসীম সত্তা, কীভাবে প্রমাণিত হয়?


আল্লাহর অসীম সত্তা, বিষয়টি প্রমাণের ক্ষেত্রে বহু পন্থা বিদ্যমান রয়েছে। যার কিছু ইমাম আলীর (আ.) বাণীতে এবং অন্যান্য দার্শনিক মনীষীদের লেখনিতে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন যে, আল্লাহকে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝানো সম্ভব না। তিনি আরও বলেন, যদি আল্লাহর কোন সীমাবদ্ধতা থাকত তবে তাকে গণনা করা যেত; কিন্তু আল্লাহ হলেন এক ও অদ্বিতীয়।

কতিপয় দার্শনিক আল্লাহর অসীম সত্তা প্রমাণ করতে গিয়ে “পরম সত্তা”, “সকল কারণের কারণ” এবং “অপরিহার্য অস্তিত্ব” -এর মতো ধারণাগুলির সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ধারণাগুলি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আল্লাহর সত্তা অসীম। দার্শনিকরা যে অন্য যুক্তিটি উল্লেখ করেছেন তা হল: সীমাবদ্ধতা হল সত্তার রূপের (প্রকৃতির) একটি অপরিহার্য অংশ, কিন্তু আল্লাহর সত্তার কোনো রূপ (প্রকৃতি) নেই (তাই তিনি অসীম)।

আল্লাহর অসীম সত্তা প্রমাণে ইমাম আলী (আ.) -এর বানী

আমিরুল মুমিনিন (আ.) নাহজুল বালাগার প্রথম খুতবায় বলেন, «و مَن اشار الیه فقد حدّه، وَ مَن حدّه فقد عدّه»[১] অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তাঁর দিকে ইঙ্গিত করে, সে তাঁকে সীমাবদ্ধ মনে করে, আর যে ব্যক্তি তাঁকে সীমাবদ্ধ মনে করে, সে তাঁকে গণনা ও সংখ্যার আওতায় আনে এবং তাঁকে বহুসংখ্যক মনে করে।

এই বাণীতে সুস্পষ্ট ভাষায়, মহান স্রষ্টার সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ, আমিরুল মুমিনিন (আ.) বলেছেন যে, যেহেতু আল্লাহ ইঙ্গিত ও সংখ্যার ঊর্ধ্বে, সেহেতু বোঝা যায় যে তিনি অসীম। আর যদি আল্লাহর সীমা থাকতো, তাহলে তাঁকে সংখ্যায় হিসাব করা যেত। আল্লাহ কখনোই গণনা বা সংখ্যার আওতায় আসবেন না এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাহলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ অসীম। কারণ, সীমাবদ্ধতা যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রে সম্ভব, এই সীমাবদ্ধতা হয় তার অনুরূপ কিছু থেকে অথবা তার বিপরীত কিছু থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। যেহেতু আল্লাহ কোন প্রকার অনুরূপ বা বিপরীত বস্তু হতে মুক্ত, তাই তিনি সীমাবদ্ধতা থেকেও মুক্ত।[২]

ইমাম আলী (আ.) অপর একটি খুতবায় বলেন, «لا یشمل بحدِّ و لا یحسب بعدٍّ و انما تحد الادوات انفسها»[৩] অর্থাৎ, আল্লাহর কোনো সীমা নেই, কোনো সীমা তাকে আবদ্ধ করতে পারে না এবং তাকে সংখ্যার মাধ্যমে গণনা করা যায় না। কেননা, যন্ত্র ও সরঞ্জাম শুধু নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী পরিমাপ করে থাকে। ইমামের এই উক্তিটিতেও মূলত আল্লাহর সীমাবদ্ধতার অস্বীকার করা হয়েছে।

এই উক্তির বিস্তারিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, আরবিতে "حد" বা সীমা শব্দের অন্যতম বিশেষ অর্থ হল নিষেধ করা। উদাহরণস্বরূপ, বাড়ির সীমা হল সেই স্থান যার সীমানা লঙ্ঘন করা নিষেধ। দেশের সীমা উত্তর ও পূর্ব দিকে এমন এমন স্থান পর্যন্ত বিস্তৃত- এ জাতীয় বিষয়। ইমাম এই উক্তিতে বলছেন যে, আল্লাহর কোনো সীমা নেই। অর্থাৎ, তার এমন কোন সীমাবদ্ধ বৈশিষ্ট্য নেই যা শুধু তার নিজস্ব এবং অন্যদের জন্য নয়। তিনি মানুষ, গাছ, ফেরেশতা ইত্যাদির মতো অন্যান্য সম্ভাব্য বস্তুর সম কাতারে নন।

যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আল্লাহ সীমাবদ্ধ, তাহলে এর অর্থ হবে যে, অন্যান্য সৃষ্টির মতো তিনিও একটি নির্দিষ্ট সত্তা হিসেবে বিদ্যমান এবং তাঁরও নির্দিষ্ট কিছু পূর্ণতা বা গুণাবলি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যের উষ্ণতা ও আলোকিত করার বৈশিষ্ট্য আছে, পানির পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, মাটির পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে; কিন্তু আল্লাহ এই উল্লিখিত বা অনুরূপ কোন বৈশিষ্ট্য দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। বরং সকল প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি মূলত তাঁর সৃজনশীলতার উৎস থেকে উদ্ভূত। সুতরাং, আমরা আল্লাহর সত্তার ব্যাপারে কোন সীমাবদ্ধতার ধারণা করতে পারি না। কেননা, যদি তা করা হয় তাহলে সীমাবদ্ধ বস্তুগুলির বৈশিষ্ট্যগুলিকে তাঁর সৃজনশীলতার সাথে সম্পর্কিত করা যাবে না। কারণ তখন তিনি নিজেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বেন। আর যে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সে নিজের বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বস্তুর উৎস হতে পারে না। অথচ, মহান আল্লাহ হলেন প্রত্যেক সৃষ্টি ও তাদের অস্তিত্বগত গুণাবলীর উৎস। অতএব বোঝা যায় যে, তিনি অসীম। এই বিষয়ের বিস্তারিত জানতে নিচের উৎসটি দেখুন।[৪]

আল্লাহ, পরম সত্তা

আল্লাহর অসীম সত্তার বিষয়ে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির তৃতীয় যুক্তি এই যে, পরম সত্তা অর্থই হচ্ছে অসীম, কেননা সীমাবদ্ধতা ত্রুটি ও অনস্তিত্ব থেকে উদ্ভূত হয়। আর যেহেতু পরম সত্তার ক্ষেত্রে অনস্তিত্ব, ত্রুটি, বহুত্ব এবং আধিক্যের মত বিষয়গুলো যায় না; সেহেতু তিনি অসীম। সুতরাং, যেহেতু আল্লাহ হলেন পরম সত্তা, শুদ্ধ অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বের শুদ্ধতম রূপ, তাই তাঁর সীমাবদ্ধ হওয়া অসম্ভব।[৫] কারণ, যদি তিনি সীমাবদ্ধ হন, তাহলে এর অর্থ হবে তিনি শুধু অসম্পূর্ণ অথবা শুদ্ধ অস্তিত্ব নন, বরং তার একটি স্বতন্ত্র রূপ বা প্রকৃতিও রয়েছে। কারণ যেখানে বহুত্ব ও আধিক্য আছে, সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকা স্বাভাবিক; আর যেখানে বহুত্ব নেই, সেখানে সীমাবদ্ধতাও নেই। আল্লাহ পাক নিজেই পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, «قل هو الله احد» আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। অতএব তাঁর সত্তার কোন বহুত্ব ও আধিক্য নেই, ফলে তিনি সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত।

আল্লাহ, সকল কারণের কারণ

আল্লাহর সত্তা অসীম হওয়ার অপর একটি যুক্তি হচ্ছে, সীমাবদ্ধতা হল পরাভূত ও অক্ষমতার সমান। অর্থাৎ, যে সত্তা কার্যকারণের ফল ও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল, সে স্বাভাবিকভাবেই সীমাবদ্ধ। আল্লাহ কোনো কিছুর প্রতি নির্ভরশীল নন এবং কারো মুখাপেক্ষী নন, বরং তিনি সকল কারণের কারণ এবং সকল কার্যকারণের উৎস এবং পরম ক্ষমতাসম্পন্ন, তাই বোঝা যায় যে তিনি কখনোই কোন সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, বরং তিনি অসীম ও অনন্ত।[৬]

আল্লাহ, অপরিহার্য অস্তিত্ব

আরও একটি যুক্তি হল, আল্লাহ হলেন অপরিহার্য অস্তিত্ব এবং এই অপরিহার্য অস্তিত্ব, অসীম ও অশেষের সমান। অন্যভাবে বললে, অস্তিত্বের বাস্তবতা হলো অসীমত্ব, অপরিহার্যতা, নিখুঁত ও বিশুদ্ধতার সমান। যেহেতু আল্লাহ হলেন অস্তিত্বের বাস্তবতা, অস্তিত্বের বিশুদ্ধতা এবং অপরিহার্য অস্তিত্ব, সেহেতু তিনি অসীম ও অনন্ত। কারণ, যদি তিনি অসীম ও অনন্ত না হন, তাহলে তিনি অপরিহার্য অস্তিত্ব হতেন না। অথচ আল্লাহর অস্তিত্ব হলো নিরঙ্কুশ অপরিহার্য এবং স্বতঃসিদ্ধ।[৭]

আল্লাহর রূপ না থাকা আল্লাহর অসীমত্ব প্রমাণের আরও একটি যুক্তি হলো যে, সীমাবদ্ধতা সর্বদা রূপ (প্রকৃতি) থেকে উদ্ভূত হয়। অর্থাৎ, রূপ (প্রকৃতি) হলো সৃষ্টিজগতের সীমাবদ্ধতার উৎস, এবং রূপ (প্রকৃতি) হচ্ছে নির্দিষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা। যেহেতু আল্লাহ রূপ (প্রকৃতি) হতে মুক্ত[৮], ফলে তিনি যেকোনো ধরনের নির্দিষ্টতা ও সীমা থেকেও মুক্ত।এভাবে বলা যায় যে, যেহেতু সকল সৃষ্টির প্রকৃতি রয়েছে, অর্থাৎ তারা নির্দিষ্ট ও তাদের নিজস্ব অস্তিত্বগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে; উদাহরণস্বরূপ, মানুষ, গাছ, প্রাণী ইত্যাদি। সুতরাং, এই ধরনের সৃষ্টি সীমাবদ্ধ। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু যেকোনো ধরনের রূপ (প্রকৃতি) ও অস্তিত্বগত নির্দিষ্টতা থেকে মুক্ত, তাই তাঁর কোনো সীমাবদ্ধতাও নেই। অর্থাৎ, যেহেতু তিনি রূপ (প্রকৃতি) থেকে মুক্ত, যা মূলত নির্দিষ্টতা ও সীমাবদ্ধতার উৎস, তাই তাঁর কোন সীমাবদ্ধতা নেই।

তথ্যসূত্র

  1. নাহজ আল-বালাঘা, খুতবা ২.
  2. জাফারী, মোহাম্মদ তাকী, নাহজ আল-বালাগেহ, তেহরান, ফারহাং ইসলামিক পাবলিশিং হাউস, ১৩৫৭, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৫-৬১।
  3. নাহজ আল-বালাগা, খুতবা ১৮৬।
  4. নাহজ আল-বালাগা, খুতবা ১৮৬।
  5. মোতাহারী, মর্তেজা, রচনা সংগ্রহ ৬, সদর পাবলিশিং হাউস, ১৩৭৯, পৃ.১০১৭।
  6. মোতাহারী, মর্তেজা, রচনা সংগ্রহ ৬, সদর পাবলিশিং হাউস, ১৩৭৯, পৃ.১০১৭।
  7. মোতাহারী, মর্তেজা, রচনা সংগ্রহ ৬, পূর্ববর্তী প্রকাশনা, পৃ.১০১৮।
  8. সদর আল-মুতালাহিন, ইসফার, বৈরুত, দার আল-আহিয়া পাবলিশিং হাউস, বিতা, ১, পৃ.