আল্লাহ যাদেরকে পছন্দ করেন

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

কুরআন শরীফ অনুসারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাদেরকে পছন্দ করেন?

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে পছন্দের মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ কুরআনে পাঁচবার উল্লেখ করেছেন যে অনুগ্রহকারীদেরকে পছন্দ করেন। পরহেযগারগণ হচ্ছেন অপর একটি দল, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার পছন্দের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও ধৈর্যশীলগণ, নিষ্পাপ ব্যক্তিগণ, তওবাকারীগণ, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিগণও হচ্ছেন তাদের অন্তর্ভূক্ত যাদেরকে পছন্দের কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে ব্যক্ত করেছেন।

অনুগ্রহকারীগণ (নেককারগণ)

কুরআন অনুসারে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নেককারদেরকে পছন্দ করেন: ﴾﴿وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ یُحِبُّ الْمُحْسِنِینَ সৎকর্ম সম্পাদন কর, কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৎকর্মশীলদেরকে পছন্দ করেন।﴿﴿(বাকারা:১৯৫) এই দলটিকে পছন্দ করার বিষয়টি কুরআনে পাঁচটি আয়াতে পুনরাবৃত্তি হয়েছে:

  • সূরা বাকারার ১৯৫ নং আয়াত
  • সূরা আলে ইমরানের ১৩৪ এবং ১৪৮ নং আয়াত
  • সূরা মায়েদার ১৩ এবং ৯৩ নং আয়াত

আল্লামা তাবাতাবায়ী সৎকর্ম বলতে যেকোন আমলকে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় এবং নির্ভূলভাবে সম্পাদন করা বলে বিবেচনা করেছেন যা কিনা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হবে।[১] নেককারদের প্রতি আল্লাহর মহব্বতের জন্য ইহলৌকিক ও পরলৌকিক দুই ধরনের প্রভাবসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; হেদায়েত, ইহকালে দ্রুত পুরস্কার পাওয়া, আল্লাহর সাহায্য, আল্লাহর রহমতের অংশীদার হওয়া, উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সফলতা লাভ করা হচ্ছে অনুগ্রহের ইহলৌকিক প্রভাবসমূহের অন্তর্গত। আর পরলৌকিক প্রভাবসমূহের উদাহরণ হিসেবে বেহেশতী নেয়ামতসমূহ এবং অধিকতর পুরস্কার, আমল গ্রহণযোগ্য হওয়া এবং শাস্তি হতে অব্যাহতির প্রতি ইশারা করা হয়েছে।[২]

তওবাকারীগণ এবং নিষ্পাপ ব্যক্তিগণ

সূরা বাকারার ২২২ নং আয়াত অনুসারে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তওবাকারীগণ এবং নিষ্পাপ ব্যক্তিগণকে পছন্দ করেন। তওবা বলতে বোঝায় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।[৩] তাওওয়াবীন শব্দের অর্থ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে অধিক পরিমাণে তওবা করে।[৪] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেকোন ধরনের তওবাকে পছন্দ করেন (ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে তওবা, আমলের মাধ্যমে তওবা, সঠিক বিশ্বাসের মাধ্যমে তওবা ইত্যাদি…)।[৫] অপর একটি আয়াতে এসেছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিচ্ছন্ন ও নিষ্পাপ ব্যক্তিদেরকে পছন্দ করেন: ﴾কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিষ্পাপ ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদেরকে পছন্দ করেন।﴿ (তওবা: ১০৮) পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার বিস্তৃত অর্থ রয়েছে যা যেকোন ধরনের শিরক ও গুনাহ’র প্রভাব হতে আত্মিক পবিত্রতা এবং দৈহিক পবিত্রতাকে শামিল করে।[৬]

পরহেযগার ও জিহাদকারীগণ

পরহেযগারগণের প্রতি আল্লাহর ভালবাসার বিষয়টি সূরা তওবার ৪ ও ৭ নং আয়াতে এবং সূরা আলে ইমরানের ৭৬ নং আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনের পরিভাষায় তাক্বওয়া তথা পরহেযগারিতা বলতে বোঝায় হারাম কর্মসমূহ হতে বিরত থাকা।[৭] মুত্তাকীন তথা পরহেযগারদের বিপরীতে হচ্ছে দুষ্কৃতিকারী, পথভ্রষ্ট, উদ্ধত, অত্যাচারী ও অপরাধীদের অবস্থান।[৮] সূরা বাকারায় পরহেযগারদের জন্য পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে:

  • গায়েব তথা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস
  • নামায কায়েম করা
  • প্রাপ্ত রিজিক ও রুযি থেকে দান করা
  • মহানবী (স.) এবং পূর্ববর্তী নবীগণের উপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি বিশ্বাস
  • পরকালের প্রতি বিশ্বাস।[৯]

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‍সূরা সাফ[১০] এবং সূরা মায়েদায়[১১] যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন তাদের প্রতি ভালবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন: ﴾﴿نَّ اللَّهَ یُحِبُّ الَّذِینَ یُقَاتِلُونَ فِی سَبِیلِهِ﴾ আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে...﴿(সাফ:৪)

তাওয়াক্কুলকারীগণ (আল্লাহর উপর নির্ভরশীলগণ)

কুরআনের আয়াত অনুসারে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাওয়াক্কুলকারীদেরকে পছন্দ করেন:﴾﴿إِنَّ اللَّهَ یُحِبُّ الْمُتَوَکِّلینَ﴾ নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন।﴿(আলে ইমরান:১৫৯) তাওয়াক্কুল বলতে বোঝায় আল্লাহর উপর আস্থা রাখা এবং তাকে অবলম্বন করা।[১২] তাওয়াক্কুল হচ্ছে ঈমানের অন্যতম দরজা।[১৩] আল্লাহর উপর ভরসাকারী ব্যক্তি হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে জানে, তার রিজিক এবং তার বিষয়টির দায়িত্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিবেন। এই কারণে সে শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে অবলম্বন করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও প্রতি তার কোন আশা থাকে না।[১৪] আল্লাহর প্রতি যাদের আস্থা রয়েছে এবং অন্যদের নিকট কোন প্রত্যাশা নেই তাদেরকে তিনি পছন্দ করেন।[১৫]

তাফসীরকারকগণ তাওয়াক্কুলের প্রকৃত অবস্থা বলতে, ক্বাযা ও ক্বাদার (ভাগ্য ও তকদীর) এর প্রতি সন্তুষ্টি ও আত্মসমর্পণ বলে মনে করেন।[১৬] বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত বলেন, “তাওয়াক্কুল হচ্ছে নৈকট্যপ্রাপ্তদের পদমর্যাদাগুলোর মধ্য হতে এবং আল্লাহর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস।[১৭]

আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানি মনে করেন তাওয়াক্কুলের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমস্ত কাজ আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া; অবশ্য এই অর্থে নয় যে, কার্য ও কারণসমূহের বিশ্বকে উপেক্ষা করব এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই অপেক্ষায় থাকবো যে অদৃশ্য থেকে কোন হাত বের হবে এবং কাজ সংঘটিত করে দিবে।[১৮]

ধৈর্যশীলগণ

যারা মুছিবতসমূহ ও কাফেরদের মোকাবিলায় পরম ধৈর্যশীল এবং নিজেদের ঈমান ও সংগ্রাম হতে পিছু হটে না, তাদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন: ﴾﴿وَ اللَّهُ یُحِبُّ الصَّابِرینَ﴾ আল্লাহ ন্যায়বিচারকগণকে পছন্দ করেন﴿(আলে ইমরান:১৪৬) রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (স.) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রত্যয় কামনা করেন যেন দুনিয়ায় আপতিত মুছিবত তাঁর জন্য সহজ হয়।[১৯]

ন্যায়বিচারকগণ (مقسطین মুকসিতিন)

﴾﴿إِنَّ اللَّهَ یُحِبُّ الْمُقْسِطِینَ﴾ নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন।﴿(মায়েদা:৪২)[২০] জুলুম বা অত্যাচারের বিপরীতে ন্যায় বিচার বা ইনসাফ হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যার উপর কুরআনেও বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।[২১] কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবীগণকে (আ.) প্রেরণ করেছেন যেন মানুষ ন্যায়নিষ্ঠাপূর্ণ আচরণ করে।[২২]

তথ্যসূত্র

  1. তাবাতাবাই, মোহাম্মদ হোসাইন, আল-মিজান ফি তাফসির আল-কুরআন, অনুবাদ করেছেন: মোহাম্মদ বাগের মুসাভি হামদানী, কওম, ইসলামিক প্রকাশনা অফিস, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৭৪, খণ্ড ৪, পৃ.২৮।
  2. আবুজার তাশকারি সালেহ, কোরানে উপকারকারীদের জন্য ঈশ্বরের ভালবাসার প্রভাব, মারফাথ পাবলিকেশন, ইমাম খোমেনী রিসার্চ ইনস্টিটিউট (রহঃ), নং ১৮০।
  3. তাবাতাবাই, মোহাম্মদ হোসাইন, আল-মিজান ফি তাফসির আল-কুরআন, অনুবাদ করেছেন: মোহাম্মদ বাকির মুসাভি হামদানী, কওম, ইসলামিক প্রকাশনা অফিস, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৭৪, খণ্ড ২, পৃ. ৩১৭।
  4. তুসি, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আল-তাবিয়ান ফী তাফসির আল-কুরআন, বৈরুত, দার ইহিয়া আল-ত্রাথ আল-আরাবি, প্রথম সংস্করণ, বেটা, খণ্ড ৬, ৪৬৮।
  5. তাবাতাবাই, মোহাম্মদ হোসাইন, আল-মিজান ফি তাফসির আল-কুরআন, অনুবাদ করেছেন: মোহাম্মদ বাকের মুসাভি হামদানী, কওম, ইসলামিক পাবলিকেশন্স অফিস, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৭৪, খণ্ড ২, পৃ. ৩১৮।
  6. মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসির আল-নাশোন, তেহরান, দার আল-কাতব আল-ইসলামিয়া, 10 তম সংস্করণ, ১৩৭১, খণ্ড ৮, পৃ. ১৪০।
  7. তাবাতাবাই, মোহাম্মদ হোসাইন, আল-মিজান ফি তাফসির আল-কুরআন, অনুবাদ করেছেন: মোহাম্মদ বাকের মুসাভি হামদানী, কওম, ইসলামিক পাবলিকেশন্স অফিস, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৭৪, ভলিউম 9, পৃ.২০২
  8. আব্বাসি, বাবাক, "তাকওয়া", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া ফাউন্ডেশন, ২০১৪, ভলিউম ৭, এন্ট্রির নীচে।
  9. সূরা বাকারা, আয়াত 2 থেকে ৪।
  10. সূরা সাফ, আয়াত ৪।
  11. সূরা মায়িদাহ, আয়াত 54।
  12. মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসির আল-নাশোন, দার আল-কাতব আল-ইসলামিয়া, ১০ তম সংস্করণ, ১৫, পৃ.
  13. মাকারেম শিরাজী, নাসের, কোরানে নৈতিকতা, কওম, আলী বিন আবি তালিব স্কুল, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৭, খণ্ড ২, পৃ.২৬৬।
  14. হোসেইনি, মালিক, এবং অন্যান্য, "তাওয়াক্কুল", ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের বিশ্বকোষ, ইসলামিক বিশ্বকোষ ফাউন্ডেশন, ২০১৩, ভলিউম ৮, প্রবেশের নীচে।
  15. তাবারসি, ফজল, মাজমা আল-বায়ান ফি তাফসির আল-কোরআন, অনুবাদকদের একটি দল, তেহরান, ফারাহানী, প্রথম সংস্করণ, বেটা, ৮, পৃ.
  16. মেয়বদি, তাফসির কাশফ আল-আবরার, জাহান ইসলাম এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে উদ্ধৃত, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া ফাউন্ডেশন, ১, পৃ.
  17. গাজ্জালী, কিমাই সাদাত, শাহিদীর উদ্ধৃতি, সাইয়্যেদ জাফর, মাশনাভী, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৫৩।
  18. সোবহানী, জাফর, মানসুর জাভিদ, খন্ড ৩, পৃ.
  19. মোহাম্মদ সাদিক আরেফ, রাহ রওশন (আল-মাহজা আল-বায়দা-এর অনুবাদ), আল-ফাইজ আল-কাশানি, খণ্ড ৭, পৃ.১৬০।
  20. সূরা মায়েদা, আয়াত 42। সূরা হাজরাত, নং আয়াত। সূরা মোমতাহনা, আয়াত ৮।
  21. সোবহানী, শেখ জাফর, মনসুর জাবেদ, ১৩, পৃ.
  22. সূরা হাদিদ, আয়াত ২৫।