উসুলে দ্বিন এবং ফুরূয়ে দ্বিনের মধ্যে পার্থক্য

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

উসুলে দ্বিন (ধর্মের মূলনীতি) এবং ফুরূয়ে দ্বিনের (ধর্মের শাখা-প্রশাখার) মধ্যে পার্থক্য পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যাখ্যা কর?

উসুলে দ্বিন (ধর্মের মূলনীতি) হচ্ছে বিশ্বাসমালা এবং ফুরূয়ে দ্বিন (ধর্মের শাখাপ্রশাখা) হচ্ছে আমল ও রীতিনীতি। উসুলে দ্বিনের ক্ষেত্রে নিজস্ব দৃঢ় বিশ্বাস এবং সুনিশ্চিত জ্ঞান থাকার প্রয়োজন, কিন্তু ফুরূয়ে দ্বিনের ক্ষেত্রে তাক্বলীদ (অনুসরণ) করা জায়েজ (বৈধ)। উসুলে দ্বিনের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির যৌক্তিক প্রমাণের মাধ্যমে দৃঢ় বিশ্বাসে পৌঁছাতে হয়, কিন্তু ফুরূয়ে দ্বিনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির যৌক্তিক প্রমাণের প্রয়োজন হয় না।

অবস্থান

ধর্মীয় আলেমগণ বলেছেন, প্রত্যেক ধর্মের উসুল ও ফুরূয় রয়েছে। উসুল হচ্ছে ধর্মের মৌলিক ভিত্তি বা মূলনীতি, যেগুলো সবার প্রথমে মানতে হবে এবং তারপরে সেই নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে যে ফুরূয় (শাখাপ্রশাখা) রয়েছে সেগুলোর আমল করতে হবে।[১]

অনেক ইসলামি আলেম মনে করেন যে, উসুলে দিনে তাক্বলিদ জায়েজ না এবং উসুলে দ্বিনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এ বিষয়ে ইজমার (ঐকমত্যের) কথাও বলা হয়েছে। আবু হানিফা, সুফিয়ান সাওরি, আওজাই, মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল এবং আহলে হাদিসের মত দলগুলো বিশ্বাস করে যে, উসুলের বিষয়গুলোর দালিলিক প্রমাণ করা ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) এবং এটাকে পরিত্যাগ করা গোনাহ হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে তাক্বলিদের মাধ্যমে উদ্ভূত বিশ্বাস গ্রহণীয়।[২]

শিয়া আলেমগণ উসুলে দিনকে পাঁচটি মূলনীতি বলে মনে করেন, কিন্তু ফুরূয়কে আট বা দশটি নীতি বলে মনে করেন। এমনকি কখনো কখনো যা কিছু উসুলে দ্বিনের বিপরীতে অবস্থিত কিন্তু ব্যবহারিক আহকামের (বিধানের) অংশ, সেগুলোকে ফুরূয়ে দ্বিন হিসেবে গণনা করেন।[৩]

ধর্মের মূলনীতি

টেমপ্লেট:মূল নিবন্ধ: উসুলে দ্বিন ধর্মীয় আলেমগণ ইসলামের বিশ্বাসের মূলনীতি (বিশ্বাসমালা) বলতে তৌহিদ (একত্ববাদ), নবুওয়াত এবং কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাসকে বুঝিয়ে থাকেন। এ তিনটি মূলনীতিকে ইসলাম ধর্মের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৪] শিয়া আলেমগণ এই তিনটি নীতির সাথে আদল (ন্যায়বিচার) ও ইমামত নামক আরও দুটি নীতি যুক্ত করেছেন এবং শিয়াদের নিকট উসুলে দ্বিন বলতে এই পাঁচটি নীতিকে বুঝায়।[৫]

ফুরূয়ে দ্বিন

টেমপ্লেট:মূল নিবন্ধ: ফুরূয়ে দ্বিন ইসলামি আমল ও রীতিনীতিমূলক আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ “ফুরূয়ে দ্বিন” হিসাবে পরিচিত। “উসুলে দ্বিন” ধর্মীয় বিশ্বাসমালার পাশাপাশি ফুরূয়ে দ্বিন হচ্ছে ইসলামের ব্যবহারিক বিষয়গুলোর সমষ্টি। বার ইমামীয়া শিয়াদের ফুরূয়ে দ্বিন হচ্ছে: নামাজ, রোজা, যাকাত, খুমস, হজ, জিহাদ, সৎকাজের আদেশ দেওয়া, মন্দ কাজে নিষেধ করা, তাওয়াল্লা এবং তাবার্রা। আহলে সুন্নাতের মাজহাবগুলো এই ফুরূয়ে দ্বিনের কয়েকটির প্রতি বিশেষ জোর প্রদান করেনি।[৬]

পার্থক্যসমূহ

  • উসুলে দ্বিন হচ্ছে বিশ্বাসের বিষয় যেখানে যুক্তি, জ্ঞান ও বিশ্বাস স্থাপন করা পূর্বশর্ত। কিন্তু, ফুরূয়ে দ্বিন এমন বিষয় যাতে আমল করা গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ কোন কাজ আঞ্জাম দেয়া অথবা কোন কাজ পরিত্যাগ করা।[৭]
  • দ্বিনে আকাঈদকে (বিশ্বাসমালাকে) "উসুল" বা মূলনীতি এবং ব্যবহারিক আহকামকে (বিধিবিধানকে) "ফুরূয়" বা শাখাপ্রশাখা বলা হয়।
  • উসুলে দ্বিনে তাক্বলীদ জায়েজ নয়, কিন্তু ফুরূয়ে দ্বিনের ক্ষেত্রে তাক্বলীদ জায়েজ।[৮] ব্যবহারিক আহকামের বিষয়ে, অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত এবং তাদেরকে বিশ্বাস করা উচিত। এই বিশ্বাসকরা এবং তাদের কথামতো আমল করাকে তাক্বলীদ বলা হয়।[৯] কিন্তু, উসুলে দ্বিনের ক্ষেত্রে মানুষকে অবশ্যই নিজে গবেষণা এবং অধ্যয়ন করার মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
  • উসুলে দ্বিনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আক্বলের (বুদ্ধিবৃত্তির) যৌক্তিক প্রমাণের মাধ্যমে বিশ্বাসে পৌঁছাতে হয়, কিন্তু ধর্মের ফুরূয়ে দ্বিনের ক্ষেত্রে আক্বলের (বুদ্ধিবৃত্তির) যৌক্তিক প্রমাণের প্রয়োজন নেই।
  • সামগ্রিক আমল ও রীতিনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েই ইবাদত, যা ইসলামি সংস্কৃতিতে "ফুরূয়ে দ্বিন" নামে পরিচিত। "উসুলে দ্বিনের" বিশ্বাসমালার পাশাপাশি, ফুরূয়ে দ্বিন ইসলামের ব্যবহারিক দিকগুলির সাথে সম্পর্কিত।[১০]
  • উসুলে দ্বিন মানুষের চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসের সাথে সম্পর্ক যুক্ত, এবং এর উপর ভিত্তি করেই ইমান ও বিশ্বাস গড়ে ওঠে। ফুরূয়ে দ্বিন মানুষের আমল ও কর্মের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। উসুলে দ্বিন প্রকৃতপক্ষে মানুষের চিন্তার পরিচয় এবং বিশ্বাস কাঠামোকে আকার দেয় এবং মুমিনদের আচরণ ও ব্যবহারকে সুস্পষ্ট করে। উসুলে দ্বিন ধর্মের মূলভিত্তি গঠন করে, যা ব্যতীত ঐ ধর্মের কোন ভিত্তি থাকবে না। এগুলো এমন যে, নীতিগুলোর যে কোনো একটিকে উপেক্ষা করলে ধর্ম ও তার লক্ষ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।[১১]
  • উসুলে দ্বিন অবহিতকরণ ও বর্ণনার মত, কিন্তু ফুরূয়ে দ্বিন হলো শিক্ষা, নির্দেশ, আদেশ ও নিষেধ।
  • ফুরূয়ে দ্বিনে নাসখ্ (রহিত) করার সুযোগ আছে, কিন্তু উসুলে দ্বিনে এর কোন সুযোগ নেই।[১২]

তথ্যসূত্র

  1. সাজ্জাদী, জাফর, ফারহাঙ্গে মা'আরিফ আল-ইসলামী, খ. ১, পৃ. ২২৩।
  2. একদল গবেষক, উসুলে দ্বিন, দানেশনামে কালামে ইসলামি, পৃ. ৫১।
  3. খতিবী কুশকাক, মুহাম্মদ ও অন্যান্য, ফারহাঙ্গে শিয়া, কোম, জমজমে হেদায়াত, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ, পৃ. ৩৬০।
  4. একদল গবেষক, “ইসলাম”, দায়েরাতুল মা’আরেফে বোঝুর্গে ইসলামি, খ. ৮, উল্লেখ্য ভুক্তির অধীনে।
  5. একদল গবেষক, উসুলে দ্বিন, দানেশনামে কালামে ইসলামি, পৃ. ৫১।
  6. একদল গবেষক, “ইসলাম”, দায়েরাতুল মা’আরেফে বোঝুর্গে ইসলামি, খ. ৮, উল্লেখ্য ভুক্তির অধীনে।
  7. একদল গবেষক, “ইসলাম”, দায়েরাতুল মা’আরেফে বোঝুর্গে ইসলামি, খ. ৮, উল্লেখ্য ভুক্তির অধীনে।
  8. খতিবী কুশকাক, মুহাম্মদ ও অন্যান্য, ফারহাঙ্গে শিয়া, কোম, জমজমে হেদায়াত, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ, পৃ. ৩৫৯।
  9. কাশেফী, মুহাম্মদ রেজা, কালামে শিয়া, কোম, পযুহেশগাহে উলুম ওয়া ফারহাঙ্গে ইসলামী, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ, পৃ. ২৫৭।
  10. একদল গবেষক, “ইসলাম”, দায়েরাতুল মা’আরেফে বোঝুর্গে ইসলামি, খ. ৮, উল্লেখ্য ভুক্তির অধীনে।
  11. হাওযা ম্যাগাজিন, মেখলেসী আব্বাস, সেইরি দার আন্দিশে হ’য়ে কালামি, খ. ৮১, পৃ. ৮৯।
  12. খতিবী কুশকাক, মুহাম্মদ ও অন্যান্য, ফারহাঙ্গে শিয়া, কোম, জমজমে হেদায়াত, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ, পৃ. ৩৫৯।