কুরআনে শিয়া শব্দ
কুরআন শরীফে শিয়া কি নেতিবাচক অর্থ বহন করে? কুরআনে শিয়া’র অর্থগুলো উল্লেখ করুন।
কুরআনে শিয়া শব্দটি দল, শ্রেণী এবং এছাড়াও অনুসারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে এই শব্দটি কখনও ইতিবাচক অর্থে যেরূপভাবে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে হযরত নূহ (আ.)-এর শিয়া ও অনুসারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং কখনও নেতিবাচক যেমন যেসব ব্যক্তিরা তাদের দ্বীনকে খণ্ড খণ্ড করে দলে দলে বিভক্ত হয়েছে, অর্থে এসেছে।
কিছু আয়াতে শুধুমাত্র কিছু কিছু দলগুলোর স্মরণ করানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোন ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন উদ্দেশ্যে নেই। উদাহরণস্বরূপ পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর জন্য উম্মতসমূহ নামে (شِیَعِ শব্দটি শিয়া শব্দের বহুবচন যার অর্থ দলসমূহ ও উম্মতসমূহ) স্মরণ করা হয়েছে।
আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থে শিয়া
শিয়ার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অংশ বিশেষ, দল ও শ্রেণী, সম্প্রদায়, অনুসারী ও সামনের চিহ্ন ধরে অনুসরণ।[১][২] কোন সম্প্রদায়ের একটি বিষয় বা একটি সত্যতার প্রতি ঐক্যমত থাকলে তাদেরকে শিয়া বলা হয়।[৩] যদি আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীদেরকে শিয়া বলা হয় তবে তা এই কারণে যে, এরা হচ্ছে সেই দল যারা আহলে বাইতের (আ.) মতাদর্শকে অনুসরণ করেন। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিয়া শব্দটি ইসলামী ফিরকাগুলোর মাঝে যে দলটি আহলে বাইতের মাসূমগণের ইমামতে বিশ্বাসী তাদেরকে নির্দেশ করে।[৪] বর্তমানে মুসলমানদের ঐ অংশটিকে শিয়া বলা হয় যারা মহানবী (স.)-এর পরপরই আলী (আ.)-এর খিলাফত ও ইমামতে বিশ্বাসী এবং এই আকিদা পোষণ করেন যে রাসূলুল্লাহর (স.) জানেশীন তথা উত্তরসূরী সরাসরি মহানবীর (স.) (শরীয়তি নাছ) মাধ্যমে নির্ধারিত হন।[৫][৬] আলী (আ.)-এর অনুসারীদেরকে শিয়া অভিহিত করণ সর্বপ্রথম মহানবী (স.)-এর পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়েছে।
বিশিষ্ট সুন্নি পণ্ডিত সুয়ুতি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহি আনসারি ও ইবনে আব্বাস এবং আলী ইবনে আবি তালিব হতে রেওয়ায়েত করেছেন যে মহানবী (স.) ﴾إِنَّ الَّذينَ آمَنُوا وَ عَمِلُوا الصَّالِحاتِ أُولئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ﴿(সূরা বাইয়্যেনা:৭) এই আয়াতের তাফসীরে আলীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন: তুমি ও তোমার শিয়ারা ক্বিয়ামতের দিন পরিত্রাণপ্রাপ্ত হবে।[৭] আহলে সুন্নতের গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে: মহানবীর (স.) কাছে অবস্থান করছিলাম, তখন আলী আসলো, রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন: কসম ঐ আল্লাহর যার হাতে আমার জীবন, সে এবং তার শিয়ারা ক্বিয়ামতের দিন মুক্তিপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন: ﴾إِنَّ الَّذينَ آمَنُوا وَ عَمِلُوا الصَّالِحاتِ أُولئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ﴿(সূরা বাইয়্যেনা:৭) মহানবীর (স.) সাহাবাগণ যখনই আলী (আ.)-কে দেখতেন, বলতেন: جاء خير البرية ; আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এসেছে।[৮]
কুরআনে শিয়া
দল ও শ্রেণী
কুরআনে শিয়ার অন্যতম একটি অর্থ হচ্ছে দল ও শ্রেণী, এই অর্থে শিয়া ৯ বার ইতিবাচক এবং ৯ বার নেতিবাচক অর্থ বহন করে। যেমন:
- ﴾قُلْ هُوَ الْقادِرُ عَلی أَنْ یَبْعَثَ عَلَیْکُمْ عَذاباً مِنْ فَوْقِکُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِکُمْ أَوْ یَلْبِسَکُمْ شِیَعاً বলুন: তিনি তোমাদের উপর থেকে অথবা পদতল থেকে আযাব পাঠাতে (সক্ষম) অথবা তোমাদেরকে দলে দলে বিভক্ত করতে সক্ষম﴿(সূরা আনআম:৬৫)
- ﴾وَ لَقَدْ أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِکَ فی شِیَعِ الْأَوَّلینَ আমি আপনার পূর্বে অতীত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।﴿(সূরা হিজর:১০)
- ﴾ثُمَّ لَنَنْزِعَنَّ مِنْ کُلِّ شیعَه أَیُّهُمْ أَشَدُّ عَلَی الرَّحْمنِ عِتِیًّا অতঃপর প্রত্যেক দল হতে দয়াময়ের প্রতি সবচেয়ে অবাধ্যকে অবশ্যই টেনে বের করব।﴿(সূরা মরিয়ম:৬৯)
- ﴾إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلا فِی الْأَرْضِ وَ جَعَلَ أَهْلَها شِیَعاً বস্তুতঃ ফেরাউন যমীনে উদ্ধত হয়ে গিয়েছিল আর সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে﴿(সূরা কাছাছ:৪)
- ﴾مِنَ الَّذینَ فَرَّقُوا دینَهُمْ وَ کانُوا شِیَعاً کُلُّ حِزْبٍ بِما لَدَیْهِمْ فَرِحُونَ যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করে ফেলেছে এবং বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেছে! এবং (আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে) প্রত্যেক দল নিজেদের কাছে যা আছে তাই নিয়ে উল্লসিত।﴿(সূরা রুম:৩২)
অনুসারী
কুরআনে শিয়া শব্দটির দ্বিতীয় ব্যবহার অনুসারী অর্থে, অনুসরণকারী তথা যে ব্যক্তি একটি বিশেষ মতাদর্শের অনুসরণ করে। সুতরাং যদি পূর্ণাঙ্গ ও উত্তম মানুষের অনুসরণ করা হয় তবে শিয়া ইতিবাচক অর্থ লাভ করে এবং যদি অত্যাচারীর অনুসরণ করা হয় তবে নেতিবাচক অর্থ লাভ করবে। আর কিছু আয়াত এই দলটিকে পরিচয় করিয়েছে যা নিম্নরূপ:
- ﴾وَ إِنَّ مِنْ شیعَتِهِ لَإِبْراهیمَ এবং তার অনুসারী হতে ছিল ইব্রাহিম﴿(সূরা সাফ্ফাত:৮৩) এই আয়াত অনুসারে হযরত ইব্রাহিম (আ.) হচ্ছেন হযরত নূহ (আ.)-এর একজন অনুসারী।
- ﴾وَ دَخَلَ الْمَدینَه عَلی حینِ غَفْلَه مِنْ أَهْلِها فَوَجَدَ فیها رَجُلَیْنِ یَقْتَتِلانِ هذا مِنْ شیعَتِهِ وَ هذا مِنْ عَدُوِّهِ فَاسْتَغاثَهُ الَّذی مِنْ شیعَتِهِ عَلَی الَّذی مِنْ عَدُوِّهِ فَوَکَزَهُ مُوسی فَقَضی عَلَیْهِ قالَ هذا مِنْ عَمَلِ الشَّیْطانِ إِنَّهُ عَدُوٌّ مُضِلٌّ مُبینٌ সে শহরে প্রবেশ করল যখন সেখানকার লোকেরা অসতর্ক অবস্থায় ছিল, সে হঠাৎ দু’জন পুরুষকে দেখতে পেল যারা সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। একজন তার দলের, অপরজন তার শত্রু দলের। তখন তার দলের লোকটি তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্যের আবেদন জানালো। তখন মূসা তার বুকে ঘুসি মারল এবং সে মৃত্যুবরণ করল। মূসা বলল: এটা শয়তানের কাজ। সে নিশ্চয় প্রকাশ্য শত্রু, গুমরাহকারী।﴿(সূরা কাছাছ:১৫) এই আয়াতে হযরত মূসার (আ.) ও ফেরাউন উভয়ের অনুসারীদেরকে শিয়া বলা হয়েছে।
- ﴾وَ حیلَ بَیْنَهُمْ وَ بَیْنَ ما یَشْتَهُونَ کَما فُعِلَ بِأَشْیاعِهِمْ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ کانُوا فی شَکٍّ مُریبٍ (শেষ পর্যন্ত) তাদের এবং তাদের কামনা-বাসনার মাঝে রেখে দেওয়া হয়েছে এক প্রাচীর, তাদের মতের ও পথের (অনুসারীদের) লোকদের ক্ষেত্রে পূর্বেও এমনটিই করা হয়েছিল, কারণ তারা ছিল সংশয়পূর্ণ সন্দেহে পতিত।﴿(সূরা সাবা:৫৪)
বিক্ষিপ্ততা ও চিন্তাধারার মধ্যে মতপার্থক্য
শিয়া কখনও কখনও চিন্তাধারাসমূহের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়া এবং বিক্ষিপ্ত হওয়া অর্থে, যা মাযহাব সৃষ্টির কারণ, ব্যবহৃত হয়:
- ﴾إِنَّ الَّذینَ فَرَّقُوا دینَهُمْ وَ کانُوا شِیَعاً لَسْتَ مِنْهُمْ فی شَیْءٍ যারা নিজেদের দ্বীনকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে নিয়েছে এবং দলে দলে (বিভিন্ন মাযহাবে) ভাগ হয়ে গেছে তাদের কোন কাজের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।﴿(সূরা আনআম:১৫৯)
তথ্যসূত্র
- ↑ ফারাহিদী, খলিল বিন আহমাদ, আল-আইন, গবেষণা: মেহেদী মাখজুমি - ইব্রাহিম সামারাই, কওম, দার আল-হিজরা ফাউন্ডেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৯ হিজরি, খণ্ড ২, পৃ. ১৯০১
- ↑ জোহরি, ইসমাইল বিন হাম্মাদ, আল-সাহ, গবেষণা: আহমেদ আবদ আল-গফুর আল-আত্তার, দার আল-আলম লামায়িন, ১৪০৭ হি/১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ, ৩, পৃ.
- ↑ ইবনে মানজুর, মুহাম্মাদ ইবনে মাকরম, লাসান আল-আরব, কওম, আদাব আল-হাওজা পাবলিশিং হাউস, ১৪০৫ হি, খণ্ড ৪, পৃ.
- ↑ ইবনে আথির জাজরি, মুবারক ইবনে মুহাম্মদ, আল-ইয়ানা ফি গারিব আল-হাদিস এবং আল-আথর, গবেষণা: তাহির আহমেদ আল-জাওয়ি, মাহমুদ মুহাম্মদ আল-তানাহি, কওম, ইসমাইলিয়ান ফাউন্ডেশন ফর প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটিং, 4র্থ সংস্করণ, ১৩৬৪, খণ্ড .২, পৃ ৫১৯।
- ↑ শেখ মফিদ, মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ, প্রারম্ভিক প্রবন্ধ, পৃ. ৩৫।
- ↑ শাহরাশতানী, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করিম, মিল্লাম ওয়া আল-নাহল, খন্ড 1, পৃ.
- ↑ সিয়ুতি, আবদ আল-রহমান বিন আবি বকর, আল-দুর আল-মুনথর ফি আল-তাফসির মাথুর, কোম, মারাশি নাজাফি পাবলিক লাইব্রেরি, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৪ হি, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৭৯।
- ↑ সিয়ুতি, আবদ আল-রহমান বিন আবি বকর, আল-দুর আল-মান্থুর ফি আল-তাফসির ইন মাথুর, কওম, মারাশি নাজাফি পাবলিক লাইব্রেরি, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৪ হি, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৭৯।