গাদীর হাদিসের উপর আহলে বাইতের (আ.) দলীল

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

কোন ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম) গাদীর হাদিস বা খুতবার মাধ্যমে তাদের ইমামত প্রমাণ করেছেন?


ইমাম আলী (আ.), হযরত ফাতেমা (আ.), ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁদের বিরোধীদের নিকট গাদীরের খুতবাকে দলিল হিসেবে উপস্থাপণ করতেন। ইমাম আলী (আ.) রাসূলুল্লাহ’র পরে তার খিলাফতের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপণ করতেন। ইমাম আলী (আ.) সকীফার ঘটনার পরে প্রথম খলিফার সাথে একটি বৈঠকে, দ্বিতীয় খলিফার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের জন্য ৬ সদস্যের শূরার বৈঠকে, তৃতীয় খলিফার খেলাফতকালীন দিনগুলোতে এবং স্বয়ং তাঁর খেলাফত আমলে এই হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ দিয়েছেন।

হযরত যাহরা (সা.আ.) মহানবী (স.)-এর মৃত্যুর পর আনসারমুহাজিরদের সাথে একটি বৈঠকে গাদীরের হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ দেন এবং তাদেরকে সেটি ভূলে যাওয়ার জন্য তিরস্কার করেন। ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি’র ঘটনায়, মহানবীর (স.) পর ইমামতের পদমর্যাদার জন্য কে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন, গাদীরের হাদীস মারফত তার প্রমাণ দেন। ইমাম হুসাইন (আ.) ও মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পূর্বে হজ্ব যাত্রায় একটি ভাষণে মুয়াবিকে ফিলাফত হরণকারী জ্ঞান করেন এবং ইমাম আলীর (আ.) ফযিলত প্রমাণে হাদীসে গাদীর’র মাধ্যমে দলিল দেন।

ইমাম আলী (আ.)

ইমাম আলী (আ.) অনেক ক্ষেত্রেই খিলাফতের বিষয়ে তার হাক্বানিয়াত (বৈধতা) প্রমাণের জন্য গাদীরের হাদীসকে দলিল হিসেবে উপস্থাপণ করেছেন।

  • আবু বকরের সাথে একটি বৈঠকে গাদীরের হাদীস দিয়ে প্রমাণ: রাসূলুল্লাহর (স.) ইন্তেকালের পর আবু বকর যখন দেখলেন যে আলী (আ.) তার প্রতি বাইয়াত করছেন না তখন ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাত করতে চান এবং আমীরুল মু’মিনীনের (আ.) সাথে কিছু কথোপকথন করেন। হযরত আলী (আ.) নিজের ফযিলতসমূহ উল্লেখপূর্বক বলেন:
أَنْشُدُکَ بِاللَّهِ أَنَا الْمَوْلَی لَکَ وَ لِکُلِّ مُسْلِمٍ بِحَدِیثِ النَّبِیِّ ص یَوْمَ الْغَدِیرِ أَمْ أَنْتَ قَالَ بَلْ أَنْت তোমাকে আল্লাহর দোহাই দিচ্ছি, গাদীর দিবসে মহানবীর (স.) হাদীস অনুসারে, আমি তোমার এবং সকল মুসলমানের অভিভাবক (মাওলা) না তুমি? আবু বকর বলেন: বরং তুমি।[১]
  • উমর ইবনে খাত্তাবের পর তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের জন্য ৬ সদস্যের শূরা’র বৈঠকে গাদীরের হাদীস দিয়ে প্রমাণ: ইমাম আলী (আ.) শূরা সদস্যদের সামনে অনেক দলিল উপস্থাপন করার পর অন্যদের উপর নিজের অগ্রাধিকারের জন্য বলেন:
আমি ব্যতীত অন্য কেউ কি আছে যার কর্তৃত্বের (বেলায়েতের) ঘোষণা রাসূলুল্লাহ (স.) গাদীরে খুমে দিয়েছেন? সকলে বললেন: আল্লাহর কসম না।[২]
  • উসমানের খিলাফতকালে গাদীরের হাদীস দিয়ে প্রমাণ: আলী (আ.) উসমানের খিলাফতকালে একদল আনসার ও কুরাইশদের একটি দলের মাঝে গাদীরে খুমে মহানবীর (স.) খুতবা, আকমালের আয়াতের অবতীর্ণ হওয়া[৩], এবং তাঁর প্রতি আবু বকর, ওমর ও লোকজনের বাইয়াতের বিষয়টি তুলে ধরেন। তখন তারা বলেন, হে আলী! চমৎকারভাবে স্মরণে রেখেছ, অথচ আমরা এই খুতবার কিছু অংশ ভূলে গিয়েছিলাম।[৪]
  • নিজের খেলাফত আমলে হাদীসে গাদীরকে দলিল হিসেবে ব্যবহার: হযরত আলী (আ.) তাঁর নিজের ফেলাফত আমলে ’রুহবাহ’ «رُحْبَه» দিবসে জনগণকে গাদীর দিবস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য সমবেত করেন এবং তাদেরকে বলেন: “তোমাদেরকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি, যে মুসলমানই মহানবী (স.) হতে শুনেছে যে গাদীর দিবসে তিনি কি বলেছেন, উঠে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিক এবং ঐ দিনে যে ব্যক্তি মহানবী ব্যতীত অন্য কাউকে দেখেছে দাঁড়িয়ে বলুক”; সাহাবাদের একটি অংশ দাঁড়ালেন এবং গাদীরের হাদীস সম্পর্কে শুনেছিলেন ও সাক্ষী ছিলেন তার সাক্ষ্য প্রদান করেন।[৫] অপর একটি রেওয়ায়েতে উল্লেখিত হয়েছে যে যায়েদ ইবনে আরকাম সাক্ষ্য প্রদান করে নি এবং আলী (আ.) তাকে তিরস্কার করেন এবং সে দৃষ্টিশক্তি হারান।[৬]
  • আনসার ও মুহাজিরদের একটি দলের সামনে গাদীরের হাদীসের মাধ্যমে দলিল উপস্থাপন; খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কুফার সমবেত মানুষের সামনে দলিল উপস্থাপন; জামালের যুদ্ধে দলিল উপস্থাপন; সিফ্ফীনের যুদ্ধে দলিল উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয়গুলো উদাহরণ হিসেবে ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।[৭] আল্লামা আমিনী’র কিতাবুল গাদীর ছাড়াও এই বিষয়ে “আল-মানাশাদাহ ওয়াল ইহতিজাজ বি হাদীসিল গাদীর” নামক ভিন্ন গ্রন্থ রয়েছে। আল্লামা আমিনী আহলে সুন্নতের রেওয়ায়েতগুলোকে সনদ সহকারে এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আলী (আ.) তাঁর খেলাফতের জন্য গাদীরের হাদীসকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করতেন।

হযরত ফাতেমা (সা.আ.)

আহলে সুন্নতের পণ্ডিত ইবনে জাযারি একটি রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন যে হযরত ফাতেমা (সা.আ.) বলেন: তোমরা কি গাদীরের দিনে রাসূলুল্লাহর (স.) বর্ণনাকে ভূলে গিয়েছো যে তিনি বলেন, আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা এবং বলেন, হে আলী! আমার কাছে তোমার অবস্থান, মূসার (আ.) কাছে হারূনের অবস্থানের ন্যায়।[৮] মাহমুদ ইবনে লুবাইদ বলেন: মহানবীর (স.) ইন্তেকালের পর ফাতেমা (সা.আ.) ওহুদের শহীদদের কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে ক্রন্দন করতেন, তাঁর নিকট জিজ্ঞেস করলাম:

রাসূলুল্লাহ (স.) কি তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে আলীর (আ.) ইমামতের উল্লেখ করেছিলেন? বলেন: কতই না আশ্চর্যের! তুমি কি গাদীরে খুমের দিনকে ভূলে গিয়েছো?![৯]

মাহমুদ ইবনে লুবাইদ বলেন:

সে রকমই, তবে মহানবী (স.) আপনাকে যা বলেছেন আমি সেটাই শুনতে ইচ্ছুক। ফাতেমা (সা.আ.) বলেন: আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি যে আমার পিতার কাছ থেকে শুনেছি, তিনি বলেন: আলী হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরসূরী যাকে তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি এবং আমার পরে সে হচ্ছে ইমাম ও খলিফা। আর আমার দুই সন্তান এবং হুসাইনের সন্তানদের মধ্য হতে ৯ জন সৎকর্মশীল ইমামগণ।[১০]

ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)

ইমাম হাসান (আ.) ৪১ হিজরীতে এবং মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধির ঘটনায় মহানবীর (স.) পর ইমামতের পদমর্যাদার জন্য কে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন, গাদীরের হাদীস মারফত তার প্রমাণ দেন এবং বলেন:

এবং সকলেই প্রত্যক্ষ করেন এবং শোনেন যখন গাদীরে খুমে মহানবী (স.) আমার পিতার হাত ধরেন এবং মানুষকে বলেন: আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা, হে আল্লাহ! যে তাঁকে ভালবাসে তুমিও তাকে ভালবাসো এবং যে তাঁর সাথে শত্রুতা করে তুমিও তার সাথে শত্রুতা করো এবং অতঃপর বলেন: উপস্থিত ব্যক্তিরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদেরকে (বার্তাটি) পৌঁছে দেবে।[১১]

এই খুতবাটি শেইখ তুসি একটু ভিন্নভাবে আল-আমালি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[১২]

ইমাম হুসাইন (আ.)

ইমাম হুসাইন (আ.) ৫৮ অথবা ৫৯ হিজরীতে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পূর্বে হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রায়, বনি হাশিমশিয়াদেরকে মিনা ভূখণ্ডে নিজের চতুর্পাশে একত্রিত করেন বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়াকে খেলাফত হরণকারী জ্ঞান করেন এবং আমীরুল মু’মিনীনের (আ.) ফযিলতের জন্য গাদীরের হাদীসকে দলিল হিসেবে ‍তুলে ধরেন এবং লোকজনের নিকট জিজ্ঞেস করেন:

أَنْشُدُکُمُ اللَّهَ أَ تَعْلَمُونَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ نَصَبَهُ یَوْمَ غَدِیرِ خُمٍّ فَنَادَی لَهُ بِالْوَلَایَةِ وَ قَالَ لِیُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ قَالُوا اللَّهُمَّ نَعَم: তোমাদেরকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি তোমরা কি জানো এভাবেই রাসূলুল্লাহ (স.), আমার পিতা আলীকে (আ.) গাদীরে খুমের দিন অভিভাবক হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং বলেন: উপস্থিত ব্যক্তিরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদেরকে (বার্তাটি) পৌঁছে দেবে? তারা সকলেই বললেন: হ্যাঁ আমরা সাক্ষ্য প্রদান করবো।[১৩]

গ্রন্থপঞ্জি

  1. ইবনে বাবাওয়াইহ, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, আল-খিছাল, কোম, জামেঅ মুদাররেসীন, প্রথম সংস্করণ, ১৩৬২ ফার্সি সন, খণ্ড ২, পৃ. ৫৫০।
  2. ইবনে মারদাভিয়া ইস্ফাহানি, আহমাদ ইবনে মূসা, মানাকিবু আলী ইবনে আবি তালিব ওয়া মা নাযালা মিনাল কুরআন ফি আলী, কোম, দারুল হাদীস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২৪ হি./১৩৮২ ফার্সি সন, পৃ. ১৩২।
  3. সূরা মায়েদা, আয়াত ৩।
  4. কান্দুযি, সুলাইমান ইবনে ইব্রাহিম, ইয়া নাবীউল মাওয়াদ্দাহ লি যিল কুরবা, দারুল উসওয়াহ লিল তাবাআহ ওয়াল নাশর, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৬ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩৪৭। শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, কামাল উদ্দীন ওয়া তামামুন নি’মাহ, কোম, মুআসসাসাতুল নাশর আল-ইসলামী, ১৪০৫ হি., পৃ. ২৭৭।
  5. ইবনে হাজর, আল-আসাবাহ, বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৫ হি., খণ্ড ৭, পৃ. ১৩৬। ইবনে আসীর, আলী ইবনে আবিল কারাম, উসদুল গাব্বাহ, বৈরুত, দারুল কিতাব আল-আরাবি, খণ্ড ৩, পৃ. ৩০৭।
  6. ইবনে আবিল হাদীদ, আব্দুল হামিদ ইবনে হাবাহুল্লাহ, শারহে নাহজুল বালাগা, কোম, কিতাব খানেয়ে মারআশি নাজাফি, ১৪০৪ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ৭৪।
  7. আমিনী, আব্দুল হুসাইন, আল-গাদীর ফিল কিতাব ওয়াল সুন্নাহ ওয়াল আদাব, কোম, মারকাযুল গাদীর লিদ্দিরাসাতিল ইসলামীয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৬ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩৩৪। পৃ. ৩৩৯। পৃ. ৩৭৮ এবং পৃ. ৩৯৪।
  8. ইবনে জাযরি, মুহাম্মাদ, আসানিল মাতালিব ফি মানাকিবিল ইমাম আলী, স্থান অজ্ঞাত, প্রকাশক অজ্ঞাত, তারিখ অজ্ঞাত, খণ্ড ১, পৃ. ৫০।
  9. খাযযায রাযি, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, কিফায়াতুল আসার ফিন নাসসি আলাল আইম্মাতিল ইসনা আশার, কোম, নাশরে বিদার, ১৪০১ হি., পৃ. ১৯৮।
  10. খাযযায রাযি, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, কিফায়াতুল আসার ফিন নাসসি আলাল আইম্মাতিল ইসনা আশার, কোম, নাশরে বিদার, ১৪০১ হি., পৃ. ১৯৮।
  11. কান্দুযি হানাফি, সুলাইমান ইবনে ইব্রাহিম, ইয়া নাবীউল মাওয়াদ্দাহ লি যিল কুরবা, দারুল উসওয়াহ লিল তাবাআহ ওয়াল নাশর, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৬ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩৬৯।
  12. তুসি, মুহাম্মাদ ইবনাল হাসান, আল-আমালি, কোম, দারুস সাকাফাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৪ হি., পৃ. ৫৬৬, মজলিস ২১।
  13. মাজলিসী, মুহাম্মাদ বাকির ইবনে মুহাম্মাদ তাকী, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, দারু ইহিয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৩ হি., খণ্ড ৩৩, পৃ. ১৮৩। আমিনী, আব্দুল হুসাইন, আল-গাদীর, খণ্ড ১, পৃ. ৩৯৮।