মহনবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি)-এর উত্তরসূরির শর্তাবলী
শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়, নবী (স.)-এর উত্তরসূরির জন্য কী কী শর্ত থাকা আবশ্যক বলে মনে করে। এই বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কী কী পার্থক্য বিদ্যমান?
শিয়া কালামশাস্ত্রবিদ খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি তার "রিসালাতুন ফিল ইমামাহ" (ইমামত সম্পর্কিত গ্রন্থ) নামক গ্রন্থে ইমামের জন্য আটটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন, যা নিম্নরূপ: ১. নিষ্পাপতা (ইসমাত), ২. শরীয়ত ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান, ৩. অসীম সাহস, ৪. কামালাত তথা যোগ্যতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব, ৫. শারীরিক ও আত্মিক ত্রুটি-বিচ্যুতি মুক্ত, ৬. আল্লাহর নৈকট্য হাসিল, ৭. মুজিজা প্রদর্শনের ক্ষমতা, ৮. পদমর্যাদায় এককত্ব। শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ইমামকে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হতে হবে, যাতে তিনি সঠিকভাবে পথপ্রদর্শন ও ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তাই যে কেউ নিজে থেকে এই অবস্থানের জন্য যে কাউকে নির্ধারণ করতে পারেন না। শিয়ারা ইমামের ইসমাত তথা নিষ্পাপতাকে একটি মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, কারণ এটি ছাড়া শরীয়তের প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ হবে।
সুন্নিরা ইমামের জন্য বেশ কিছু শর্ত বিবেচনা করে, যেমন: ১. কুরাইশ গোত্রের সদস্য হওয়া, ২. ন্যায়পরায়ণতা, ৩.প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া (বালিগ), ৪. সাহস। তবে কিছু অন্যান্য গুণ যেমন ইজতিহাদ (ধর্মীয় বিধান উদ্ভাবনের ক্ষমতা) এবং কিফায়া (যোগ্যতা) নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ সুন্নি ইমামের কুরাইশ গোত্র হওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে তবে তাদের কিছু কিছু দল যেমন, খাওয়ারিজ এবং মুতাজিলা এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করে। সুন্নিরা মনে করে যে ইমামের নিষ্পাপ হওয়া আবশ্যক নয়। এমনকি যদি তিনি ভুলও করেন, তবুও তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। এতদসত্ত্বেও কেউ কেউ এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। আর প্রথম তিন খলিফার (আবু বকর, উমর ও উসমান) মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলীর কিছু কিছুর অনুপস্থিতির কারণে, কিছু লোক মনে করে যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি ইমামের জন্য অপরিহার্য নয়।
শিয়া মতে ইমামের শর্তাবলী
শিয়া ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি তার ইমামত সম্পর্কিত গ্রন্থে ইমামের গুণাবলির সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকা উপস্থাপন করেছেন। তিনি ইমামের জন্য আটটি মৌলিক গুণাবলীকে অপরিহার্য জ্ঞান করেছেন:
- ইসমাত তথা নিষ্পাপত্ব
- শরীয়তী বিধি-বিধান ও ব্যবস্থাপণা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান
- অসীম সাহসিকতা
- কামালাত তথা যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব
- শারীরিক, আত্মিক ও বংশগত ত্রুটিমুক্ততা
- পরলৌকিক পুরস্কার নিশ্চিতে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল
- প্রয়োজনে মুজিজা প্রদর্শনের ক্ষমতা
- ইমামতের পদে এককত্ব।[১]
ইমামিয়া শিয়ারা খিলাফত ও ইমামতকে নবুয়তের মতোই ঐশ্বরিক পদ হিসেবে বিবেচনা করে। খলিফা ও ইমামের দায়িত্ব হল শরিয়ত সংরক্ষণ, ধর্মের প্রচার ও প্রসার এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধান করা। এজন্যই গ্রহনযোগ্য ও বৈধ ইমামের জন্য এমন কিছু শর্ত ও বৈশিষ্টাবলীর কথা বলা হয়, যা না থাকলে একজন ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে ইমাম ও নবীর উত্তরসূরি হতে পারে না।[২]
ইসমাত তথা নিষ্পাপত্ব
ইমাম ও খলিফাকে অবশ্যই নিষ্পাপ বা মাসুম হতে হবে, অর্থাৎ পাপ, ভুল ও ত্রুটিমুক্ত। যদি ইমাম নিষ্পাপ না হন, তাহলে শরিয়তের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে; প্রকৃতপক্ষে, ধর্মের রক্ষক যদি পাপে লিপ্ত হয় বা ভুল করে থাকে তবে তার দ্বারা ধর্মে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সম্ভাবনা থাকে এবং ঐ পরিবর্ধন আল্লাহর উপর আরোপ করার সম্ভাবনা থাকে অথবা সে কোন হুকুমের ক্ষেত্রে ন্যায় বহির্ভূত আচরণ করতে পারে। এছাড়াও সাধারণ মানুষের দ্বারা ভুল ও পাপ সংঘটিত হতে পারে, সুতরাং তাদের জন্য এমন কারও প্রয়োজন যে তাদেরকে ভুল বা পাপাচার থেকে দূরে রাখবে এবং সঠিক পথে পরিচালিত করবেন। অথচ ইমামও যদি পাপে লিপ্ত ও ভুলে নিমজ্জিত হন তবে এটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।[৩]
আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত
ইমামত ও খিলাফত হল আল্লাহ ও নবী করিম (স.)-এর প্রতিনিধিত্ব; তাই এটির নিয়োগ স্পষ্টভাবে মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন ও নবী (স.)-এর পক্ষ থেকে হতে হবে। যেহেতু তাদের নিয়োগের অধিকার কেবল আল্লাহ ও তার রাসূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তাই অন্যদের ইমাম নিয়োগের অধিকার নেই। প্রকৃতপক্ষে, যদি ইমামের নিয়োগের বিষয়টি মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেবে—প্রতিটি গোষ্ঠী কাউকে না কাউকে নির্বাচন করবে এবং অন্যদের তুলনায় তাকে প্রাধান্য দেবে। সুতরাং ইমামকে অবশ্যই আল্লাহ ও তার রাসূল (স.) এর পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে।[৪]
ইমামের জ্ঞান
শিয়া ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, নবী (স.)-এর ইমাম ও খলিফাকে অবশ্যই ধর্মীয় ও পার্থিব সকল বিষয়ে মুসলমানদের প্রয়োজনীয় সমস্ত জ্ঞানে পারদর্শী হতে হবে। কারণ, ইমাম নিয়োগের উদ্দেশ্য হল মুসলমানরা যেন তাদের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য তার শরণাপন্ন হতে পারে। ইমামিয়া শিয়ারা মনে করেন যে, ইমামতের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও যোগ্যতা সর্বোচ্চ স্তরে থাকা আবশ্যক। শিয়া সূত্রগুলো নির্দেশ করে যে, ইমামকে অবশ্যই সকল ইসলামী জ্ঞান ও শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। কারণ, এই জ্ঞান ছাড়া ইমামতের লক্ষ্য (শরীয়তের বিধান সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যা করা) পূর্ণভাবে অর্জিত হতে পারে না।[৫]
ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব
পূর্ণাঙ্গ গুণাবলির ক্ষেত্রে যেমন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, উদারতা, বীরত্ব, সাহস, ন্যায়পরায়ণতা, ধার্মিকতা, ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমামকে অবশ্যই সকল মুসলিমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে হবে।[৬] ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়টি এমন একটি বিষয় যা জায়দিয়া ও ইসমাঈলিয়া’র ন্যায় কিছু কিছু ফিরকাও এই ধারনায় বিশ্বাসী। এছাড়াও, মোল্লা সদরার মতো কোন কোন পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে, ইমামগণ সৃষ্টি গত দিক থেকে অন্য সকল সৃষ্টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী।[৭]
আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে ইমামের শর্তাবলী
বিশিষ্ট সুন্নি পণ্ডিত সা'দুদ্দীন আত-তাফতাজানী, সুন্নিদের মতানুসারে, ইমামের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলোর একটি তুলনামূলক পূর্ণাঙ্গ তালিকায় উল্লেখ করেছেন:
- প্রাপ্তবয়স্কতা (বালিগ),
- ন্যায়পরায়ণতা,
- মুক্ত হওয়া (দাসত্বমুক্ত),
- পুরুষ হওয়া,
- ইজতিহাদ (ধর্মীয় বিধান উদ্ভাবনের ক্ষমতা),
- সাহস,
- পরিচালনা দক্ষতা,
- কুরাইশ গোত্রের সদস্য হওয়া।[৮]
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে প্রথম চারটি শর্তের ব্যাপারে সকলেই একমত। তবে ইজতিহাদ, সাহস ও পরিচালনা দক্ষতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন কালামশাস্ত্রবিদ এগুলোর অধিকারী হওয়াকে বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন না, কারণ এসব গুণের কমতি শুধুমাত্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও অযাচিত দায়িত্বের সৃষ্টি করতে পারে। কুরাইশ বংশীয় হওয়ার শর্তটি অধিকাংশ মুসলিম গ্রহণ করেছেন, যদিও খাওয়ারিজ ও মুতাজিলা সম্প্রদায়ের কেউ কেউ এটা প্রত্যাখ্যান করেছেন।[৯]
অপর সুন্নি পণ্ডিত আহমাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব আন-নুওয়াইরী তার গ্রন্থ নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আদব-এ ইমামত পদের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলোকে কয়েকটি বিভাগে বর্ণনা করেছেন। তিনি এ শর্তগুলোকে দুই ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করেন:
- প্রচলিত শর্তাবলী (সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত),
- ধর্মীয় শর্তাবলী (শরীয়াহ ভিত্তিক)।
এরপর তিনি ইমামের শর্তাবলীকে একটি সাধারণ শ্রেণিবিন্যাসে উপস্থাপন করেন।[১০]
বংশগত শর্ত
সুন্নি সূত্রগুলোতে, ইমাম হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে কুরাইশ গোত্রীয় হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্নিরা এ সংক্রান্ত যে হাদিসটি উদ্ধৃত করে, তাতে বলা হয়েছে: "ইমাম অবশ্যই কুরাইশ গোত্রের হবেন।"[১০] সুতরাং, যদি কুরাইশ গোত্রে ইমামতের প্রয়োজনীয় শর্তপূরণকারী কেউ না পাওয়া যায়, তাহলে কুরাইশের নিকটতম গোত্র কিনানাহ থেকে ইমাম নির্বাচন করতে হবে। যদি কিনানাহ গোত্রেও যোগ্য ব্যক্তি না পাওয়া যায়, তাহলে অন্যান্য আরব গোত্র থেকে ইমাম নির্বাচিত হবে।[১১]
জ্ঞান ও দক্ষতা
সুন্নি মতে ইমামতের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো ইমামের ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ও বোঝাপড়া থাকতে হবে। ইমামকে অবশ্যই যাকাত ব্যবস্থাপনা, জিহাদ পরিচালনা এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। এই শর্তের যুক্তি হলো: যদি ইমাম শরীয়ত ও ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী না হন, তবে তিনি সেগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হবেন না। নবাবী এ বিষয়ে বলেছেন: ”ইমামতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয়াদী সম্পর্কে যে ইমাম জ্ঞান রাখেন না, সেই ইমামের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি একই কথা।"[১২]
এছাড়া সুন্নি সূত্রগুলোতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইমামকে অবশ্যই সাধারণ বিষয়াবলি, সুসজ্জিত বাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষার ক্ষেত্রে সাহসী হতে হবে। এছাড়াও ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রভাবমুক্ত হয়ে ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে।[১৩]
ন্যায়পরায়ণতা
সুন্নি কালামশাস্ত্রীয় সূত্রসমূহের তথ্য অনুযায়ী, ইমামকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। ধর্মীয় বিষয়াবলী ও ব্যক্তিগত লেনদেনের ক্ষেত্রে তাকে ন্যায়নীতিবান হতে হবে। আহলে সুন্নতের একটি দলের পণ্ডিতের যুক্তি হলো, যেহেতু ফাসেক ব্যক্তি ঈমানের গণ্ডির বাইরে অবস্থান করে, তাই এমন ব্যক্তি মুসলিমদের ইমামতের দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা রাখে না। যদি কুরাইশ গোত্রের মধ্যে একজন আলেম (জ্ঞানী) কিন্তু নীতিবান নয়, পক্ষান্তরে একজন আলেম নয় কিন্তু নীতিবান ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন, তবে উক্ত নীতিবান ব্যক্তিকেই ইমাম নির্বাচন করতে হবে। প্রয়োজনে, তিনি ধর্মীয় পণ্ডিতদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন।[১৪]
সুন্নিদের অন্যান্য কালামশাস্ত্রীয় সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমামকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ ও পরহেজগার হতে হবে যাতে করে তিনি জনগণকে সত্য পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হন। কারণ যে ব্যক্তির ন্যায়পরায়ণতা নেই, সে নেতৃত্বের জন্য যোগ্য নয়। সুন্নিদের মতে, সরকার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রয়োজন অনুসারে তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। অথচ কোনো অত্যাচারী শাসকের সমর্থন করা বৈধ নয়। সুতরাং শাসককে সর্বদা ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে হবে।[১৫]
পূর্ববর্তী ইমাম কর্তৃক নিয়োগ অথবা চল্লিশ মু’মিনের পক্ষ থেকে নির্বাচন
যদি কোনো ব্যক্তি ইমামতের জন্য প্রয়োজনীয় সকল শর্তের অধিকারী হন এবং পূর্ববর্তী ইমাম তাকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে নিযুক্ত করে যান, তবে তার নিয়োগে কোনো আপত্তি নেই। যদি পূর্ববর্তী ইমাম কাউকে উত্তরসূরি হিসেবে নিযুক্ত না করে থাকেন, কিন্তু মুসলিম সমাজের জন্য নতুন ইমাম নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়ে, তাহলে চল্লিশজন আদেল (ন্যায়পরায়ণ) ও আলেম (পণ্ডিত) মুসলিম ব্যক্তি পর্যালোচনা ও ইজতিহাদের মাধ্যমে ইমাম নির্বাচন করতে পারেন। এই নির্বাচনে সর্বপ্রথম সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে সম্মতি জ্ঞাপন ও চুক্তি করবেন, তারপর অন্যান্য জ্ঞানহীন ব্যক্তিরা।[১৬]
বিচারক আব্দুর রহমান আল-ইজ্জী এ বিষয়ে বলেন:
- «ইমামত প্রতিষ্ঠিত হয় বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথের মাধ্যমে, যেমন আবু বকরের ইমামতের ক্ষেত্রে হয়েছিল... ইমামত প্রতিষ্ঠার জন্য উম্মতের সর্বসম্মতি প্রয়োজন নয়। কারণ, ইমামত প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পূর্ণ সম্প্রদায়ের শপথ আবশ্যক—এমন কোনো যুক্তিগ্রাহ্য বা ধর্মীয় প্রমাণ নেই। সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এক বা দুজনের বাইয়াতই ইমামত প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট।»[১৭]
ইমামতের কিছু কিছু শর্ত প্রত্যাখ্যান
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি)-এর পরবর্তী তিন খলিফা, ইমামতের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কিছু শর্তের অধিকারী না হওয়ায় সুন্নি আলেমদের মধ্যে ইমামের শর্তাবলি নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। বিচারক আব্দুর রহমান আল-ইজ্জী তার মাওয়াকিফ গ্রন্থে এ শর্তগুলো উল্লেখ করে বলেন: "ইমামিয়া শিয়ারা দাবি করেন যে, ইমাম অবশ্যই হাশেমি বংশীয়, ধর্মীয় সকল বিষয়ে অগাধ জ্ঞানী, মুজিজা প্রদর্শনে সক্ষম ও মাসুম বা নিষ্পাপ হতে হবে। কিন্তু আমরা এসব শর্ত মানি না, কারণ আবু বকর খলিফা হয়েছিলেন এই গুণাবলি ছাড়াই।"[১৮]
বিচারক আবু বকর আল-বাকিলানী বলেন: «ইমামের মাসুম বা নিষ্পাপ হওয়া জরুরি নয়; সমসাময়িক মানুষের মধ্যে ইমামের শ্রেষ্ঠ হওয়া আবশ্যক নয়, এমনকি জ্ঞানগত দিক থেকেও অন্যদের চেয়ে তার শ্রেষ্ঠ হওয়ারও প্রয়োজন নেই। অধিকাংশের মতে, যদি ইমাম ফাসেক হয়ে যান, মানুষের ক্ষতি করেন, তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করেন, মানুষ হত্যা করেন, মানুষের অধিকার উপেক্ষা করেন বা শাস্তির বিধান স্থগিত রাখেন—তবুও তাকে ইমামত থেকে অপসারণ করা যাবে না। এমনকি জালিম হলেও তার আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক।»[১৯]
তথ্যসূত্র
- ↑ তুসী, নাসিরউদ্দিন, তালখিসুল মুহাসসাল (আরবি), বেইরুত, দারুল আদওয়া, ১৪০৫হি, পৃ৪২৯-৪৩০।
- ↑ সুবহানী, জাফর, দানেশ নামায়ে কালামে ইসলামী, জি১, কুম, মো'আসসাসায়ে ইমাম সাদিক, ১৩৮৭শ, পৃ৪২৬-৪৩০।
- ↑ খানসারি, মুহাম্মাদ বাকির, ইনসাফ দর ইমামত, তেহরান, নশর-এ সাদূক, ১৩৭১শ, পৃ৩৫।
- ↑ খানসারি, মুহাম্মাদ বাকির, ইনসাফ দর ইমামত, তেহরান, নশর-এ সাদূক, ১৩৭১শ, পৃ৩১।
- ↑ সুবহানী, জাফর, দানেশ নামায়ে কালামে ইসলামী, জি১, কুম, মো'আসসাসায়ে ইমাম সাদিক, ১৩৮৭শ, পৃ৪২৬-৪৩০।
- ↑ খানসারি, মুহাম্মাদ বাকির, ইনসাফ দর ইমামত, পৃ৩২।
- ↑ সুবহানী, জাফর, দানেশ নামায়ে কালামে ইসলামী, জি১, কুম, মো'আসসাসায়ে ইমাম সাদিক, ১৩৮৭শ, পৃ৪২৬-৪৩০।
- ↑ তাফতাযানী, সাদউদ্দিন, শরহুল মাকাসিদ (আরবি), জি৫, কুম, মনশুরাতে শরীফ রেযি, ১৪০৯হি, পৃ২৪৪।
- ↑ তাফতাযানী, সাদউদ্দিন, শরহুল মাকাসিদ (আরবি), জি৫, কুম, মনশুরাতে শরীফ রেযি, ১৪০৯হি, পৃ২৪৪।
- ↑ নাওয়াবী, আহমাদ, নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আদব (আরবি), জি৬, কায়রো, দারুল কুতুব ওয়াল ওসাইফ আল-কওমিয়া, ১৪২৩হি, পৃ১।
- ↑ নাওয়াবী, আহমাদ, নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আদব (আরবি), জি৬, কায়রো, দারুল কুতুব ওয়াল ওসাইফ আল-কওমিয়া, ১৪২৩হি, পৃ১-৩।
- ↑ নাওয়াবী, আহমাদ, নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আদব (আরবি), জি৬, কায়রো, দারুল কুতুব ওয়াল ওসাইফ আল-কওমিয়া, ১৪২৩হি, পৃ২।
- ↑ আল-আবদারী আল-গারনাতী, মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ, আত-তাজ ওয়াল ইকলিল লিমুখতাসার খালিল (আরবি), জি৮, বেইজান, দারুল কুতুবুল ইলমিয়া, ১৪১৬হি, পৃ৩৬৬।
- ↑ নাওয়াবী, আহমাদ, নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আদব (আরবি), জি৬, কায়রো, দারুল কুতুব ওয়াল ওসাইফ আল-কওমিয়া, ১৪২৩হি, পৃ২-৩।
- ↑ আল-আবদারী আল-গারনাতী, মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ, আত-তাজ ওয়াল ইকলিল লিমুখতাসার খালিল (আরবি), জি৮, বেইজান, দারুল কুতুবুল ইলমিয়া, ১৪১৬হি, পৃ৩৬৬।
- ↑ নাওয়াবী, আহমাদ, নিহায়াতুল আরব ফি ফুনুনিল আদব (আরবি), জি৬, কায়রো, দারুল কুতুব ওয়াল ওসাইফ আল-কওমিয়া, ১৪২৩হি, পৃ১-৩।
- ↑ কাযী ইজি, আল-মাওয়াকিফ, জি৩, পৃ৫৯৪।
- ↑ কাযী ইজি, আবদুর রহমান বিন আহমাদ, আল-মাওয়াকিফ, জি৩, পৃ৫৮৬, দারুল জিল, বেইরুত, ১৪১৭হি।
- ↑ বাকিলানি, তাহমীদুল আওয়াইল ওয়া তালখিসুদ দালায়িল, পৃ৪৭০, মো'আসসাসায়ে আল-কুতুব আস-সাকাফিয়্যাহ, বেইরুত, ১৪১৪হি।