মহানবী (স.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তি দিবস (মাবআস)
মহানবী (স.)-এর নবুওয়াতে অভিষেক কোন সময়ে ও মহানবীর (স.) কত বছর বয়সে সংঘটিত হয়েছে এবং মুসলমানদের মাঝে এর গুরুত্ব কি?
মহানবী (স.)-এর বে’সাত হচ্ছে হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর রিসালাত প্রাপ্তির দিন যা ৪০ আমল ফীলে সংঘটিত হয়। শিয়ারা মহানবীর (স.)- এর মাবআস (মহানবীর (স.) নবুওয়াতে অভিষেক দিবস) ২৮ রজব বলে মনে করেন এবং আহলে সুন্নত বিশ্বাস করেন মাবআস রমজান মাসে সংঘটিত হয়েছে। প্রসিদ্ধ মুসলমানগণের বিশ্বাস হচ্ছে হযরত মুহাম্মাদ (স.) চল্লিশ বছর বয়সে অভিষিক্ত (নবুওয়াত প্রাপ্ত) হয়েছেন।
মহানবী (স.)-এর বে’সাত-কে (নবুওয়াত প্রাপ্তি) নবুওয়াতী সীরাত ও ইতিহাসে সংঘটিত হওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ও বুনিয়াদী ঘটনা জ্ঞান করা হয়। মাবআস, ইসলামের সকল ফিরকাসমূহের সংস্কৃতিতে বড় ঈদ হিসেবে বিবেচিত এবং ইসলামী ভূখণ্ডের সর্বত্র এটি উদযাপন করা হয়।
গুরুত্ব
বে’সাতকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিরাট নেয়ামত ও রহমত[১] এবং নবুওয়াতী সীরাত ও ইতিহাসে সংঘটিত হওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ও বুনিয়াদী ঘটনা জ্ঞান করা হয়।[২] বে’সাতের ঘটনা মুসলমানদের সংস্কৃতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।[৩] প্রকৃতপক্ষে বে’সাতের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের শুরু; যে ধর্ম তার প্রথম বছরগুলোতে স্বল্প সংখ্যক অনুসারীর মাধ্যমে এবং কঠিন পরিস্থিতিতে যাত্রা শুরু করে এবং পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মাবআসকে মানবতার ইতিহাসে একটি বিরাট পরিবর্তনের শুরুর সময় হিসেবে গণ্য করা হয়।[৪] মহানবী (স.)-এর নবুয়াতে অভিষেকের দিবসটি (মাবআস) ইসলামের সকল ফিরকার সংস্কৃতিতে একটি বড় ঈদ হিসেবে বিবেচিত এবং মাবআসের দিন উপলক্ষে ইসলামী ভূখণ্ডের সর্বত্র প্রত্যেক দেশের রীতি-নীতি অনুযায়ী জাঁকজমকপূর্ণভাবে উৎসব পালন করা হয়।[৫]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ নং আয়াতে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আল্লাহ মু’মিনদের অনুগ্রহ করেছেন যে নবুওয়াতকে তাদের মধ্য হতে তাদের মাঝে মনোনীত করেছেন।[৬] শিয়াদের বিশ্বাস অনুসারে মহানবীর (স.) মাবআস সংঘটিত হয় ৪০ আমল ফীল ২৭ রজব রোজ সোমবার (৬১০ খ্রি.) এবং ইরানের খসরু পারভেজের হুকুমতের ২০তম বছরে।[৭] আহলে সুন্নতের পণ্ডিতগণ ও মুহাদ্দেসগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে যে, মহানবীর (স.) বে’সাত ৪০ আমল ফীলের পবিত্র রমজান মাসে সংঘটিত হয়েছিল; তবে তাদের কেউ কেউ এটিকে ১৭ রমজান, কেউ কেউ ১৮ রমজান এবং একটি দল আবার উক্ত মাসের ২৪ তারিখে বলে বর্ণনা করেছেন।[৮]
বে’সাতের শুরু
মহানবীর (স.) বে’সাত ৪০ বছর বয়সে (অপ্রসিদ্ধ মত হচ্ছে ৪৩ বছর বয়সে) সংঘটিত হয়; এই মতপার্থক্যের কারণ, বে’সাতের অর্থের ভিন্ন ভিন্ন অনুমান অর্থাৎ কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ ও বে’সাত কি একই, অথবা আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য প্রচার।[৯]
মহানবী (স.) যখন সূর পাহাড়ের হিরা গুহায় চিন্তা ও ইবাদতে মশগুল ছিলেন, সূরা আলাকের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হওয়া তথা “পড় সেই প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন” দ্বারা তাঁর দাওয়াত শুরু হয় এবং সূরা মুদাসসিরের প্রথম আয়াতের মাধ্যমে তা অব্যাহত থাকে। মহানবী (স.) প্রথমে তাঁর স্ত্রী খাদিজা এবং তাঁর চাচাত ভাই আলী (আ.)-কে নিজের নবুওয়াতের বিষয়টি অবহিত করেন। তিন বছর পর «وَاَنْذِرْ عَشیرَتَک الاْقْرَبین»[১০] আয়াতটি নাযিল হওয়ার মাধ্যমে দাওয়াত নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে এবং ঐ একই বছর ﴾فَاصْدَع بِما تُؤْمَرُ وَاَعْرِض عَن الْمُشْرِکین অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না।﴿(হুজরাত:১৫।) আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে প্রচার আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য রূপ লাভ করে।
প্রথমবার মহানবী (স.) উকায বাজারে, যেখানে মানুষ ব্যবসার জন্য জড়ো হয়েছিল এবং কিছু সংখ্যক সেখানকার উঁচু স্থানগুলোতে নতুন কবিতা এবং বিভিন্ন ধরনের গল্প বলায় মশগুল ছিলেন, সকলকে চুপ করতে বললেন এবং প্রকাশ্যে দাওয়াত দিলেন। সেদিন আবু লাহাব মহানবী (স.)-কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং কিছু সংখ্যক তাকে অনুসরণ করে মহানবী (স.)-কে আঘাত করে; কিন্তু আবু তালিব মহানবী (স.)-কে সমর্থন স্বরূপ তাদেরকে তিরস্কার করেন, অল্প সংখ্যক ঈমান আনেন এবং এই তিন বছরে গোপনে ঈমান আনা ছোট্ট একটি দলের সাথে যোগদান করেন।[১১]
বলা হয় মহানবী (স.)-এর বে’সাতের প্রথম চিহ্নগুরো তাঁর ৪০ বছর বয়সে রমজান মাস অথবা রজব মাসের একটি রাত্রে হিরা গুহায় মহানবীর (স.) নিকট ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং তাঁর সামনে সূরা আলাকের প্রথম আয়াত পাঠ করেন। বলা হয়ে থাকে কিছু সময়ের জন্য ওহী অবতীর্ণ হওয়া স্থগিত হয়ে যায় এবং এই বিষয়টিই মহানবী (স.)-এর জন্য মনোবেদনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অল্প সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ওহীর ফেরেশতা পূণরায় আগমন করে এবং মহানবী (স.)-কে তাঁর সম্প্রদায়ের হেদায়েতের জন্য নিযুক্ত করেন।[১২] তাফসীরে নেমুনেহ-তে বলা হয়েছে, বেশীর ভাগ তাফসীরকারকগণ বিশ্বাস করেন, সূরা আলাক হচ্ছে মহানবী (স.)-এর উপর অবতীর্ণ হওয়া প্রথম সূরা।[১৩]
তথ্যসূত্র
- ↑ বালাগী, সদর আল-দিন, "মাবাআত খাতাম আল-আম্বিয়া", দার আল-সালাম, ২৪, মে ১৩৩১, পৃ।
- ↑ সৈয়দ আলাভি, সৈয়দ ইব্রাহিম, "তাবারির ইতিহাসে নবীর মিশন", কিহান আন্দিশেহ, নং ২৫, ১৩৬৮, পৃ. ৫৭।
- ↑ মাতি, মাহদী, "বাথ", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া সেন্টার, ভলিউম 12, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ মাতি, মাহদী, "বাথ", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া সেন্টার, ভলিউম 12, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ আলাভী মেহর, হোসাইন, "মিশন এবং এর উদ্দেশ্য", ফারহাং কাউসার, নং ৪৪, ১৩৭৯, পৃ.
- ↑ ম্যানেজার শেন চি, কাজেম, "দ্য মেসেঞ্জার অফ হোলি প্রফেট (সাঃ)", নাম আস্তান কুদস, নং ২৯ এবং ৩০, ১৩৪৬, পৃ. ১৭; মাতি, মাহদী, "বাথ", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া সেন্টার, ভলিউম ১২, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ ম্যানেজার শেন চি, কাজেম, "দ্য মেসেঞ্জার অফ হোলি প্রফেট (সাঃ)", নাম আস্তান কুদস, নং ২৯ এবং ৩০, ১৩৪৬, পৃ. ১৭; মাতি, মাহদী, "বাথ", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া সেন্টার, ভলিউম ১২, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ নবী (সাঃ) কে কোন তারিখে নবী হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিল?", আয়েন রহমত, পরিদর্শন করেছেন: ২৪ বাহমান ১৪০২ হিজরি।
- ↑ মাতি, মাহদী, "বাথ", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া সেন্টার, ভলিউম ১২, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ সূরা শারা, আয়াত ২৬।
- ↑ মাতি, মাহদী, "বাথ", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া সেন্টার, ভলিউম ১২, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ লেখকদের একটি দল, "ইসলাম", ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া, তেহরান, ভলিউম 8, এন্ট্রির নীচে।
- ↑ মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসির আল-নাশোন, তেহরান, দার আল-কাতব আল-ইসলামিয়া, ১৩৭১, খণ্ড ২৭, পৃ. ১৫৩।