বেলায়াত

WikiPasokh থেকে
প্রশ্ন

বেলায়াতের ধারণাটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করুন।


বেলায়াত অর্থ হল বান্দাদের উপর আল্লাহর কর্তৃত্বের একটি ইসলামি পরিভাষা, যা দুইভাগে বিভক্ত: তাকবিনি (সৃষ্টিগত) এবং তাশরিয়ি (আইনগত)। তাকবিনি বেলায়াত বলতে সৃষ্টি ব্যবস্থা ও এর নিয়মকানুনের উপর কর্তৃত্ব। এই বেলায়াত শুধু আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। অনেকে মনে করে যে, বান্দেগীর পূর্ণতার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিশ্বজগত ও মানবজাতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাশরিয়ি বেলায়াত হল শরিয়তের সীমার মধ্যে বেলায়াত, যা আল্লাহর বিধানের অধীন এবং প্রথাগত ও চুক্তিভিত্তিক বিষয়ে কর্তৃত্বের একটি ধরন।

আল্লাহর বেলায়াত, তা তাকবিনি হোক বা তাশরিয়ি, তা হল তাঁর সত্ত্বাগত বেলায়াত। আল্লাহ তা’আলা তাকবিনি ও তাশরিয়ি বিষয়ে মহানবী (সা.) এবং মাসুম ইমামদেরকে (আ.) বেলায়াতের অধিকারী করেছেন। কেউ কেউ ফকিহের নিরঙ্কুষ বেলায়াতকে (বেলায়েতে ফকিহ) ইমামদের (আ.) বেলায়াতের অধীনস্ত একধরনের তাশরিয়ি বেলায়াত হিসেবে গণ্য করেন।

বেলায়াতের ধারণাটি ইরফানের মৌলিক ধারণাগুলোর একটি। ইরফানি বেলায়াত হল এক ধরনের তাকবিনি বেলায়াত যেখানে আল্লাহর বান্দা বান্দেগীর পথ অনুসরণ করে নিজের অস্তিত্ব বিলীন (ফানা) করে আল্লাহতে স্থায়িত্ব (বাকা বিল্লাহ) লাভ করে।

বেলায়াতের ধারণা ও প্রকারভেদ

বেলায়াত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল দুটি জিনিসের মধ্যে এমন নৈকট্য যেখানে তাদের মাঝে কোনো ব্যবধান থাকে না।[১] গবেষকরা বেলায়াত শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে বলেন যে, “বেলায়াত” (وِلایت) সাহায্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়, আর “ওয়ালাইয়াত” (وَلایت) কোনো কাজের দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে এও বলা হয়েছে যে, উভয়ের অর্থ একই এবং এর প্রকৃত অর্থ হল দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব।[২]

বেলায়াত তাকবিনি ও তাশরিয়ি দুই ভাগে বিভক্ত:

  • তাকবিনি বেলায়াত: এর অর্থ হল সৃষ্টি ব্যবস্থা ও এর নিয়মকানুনের উপর কর্তৃত্ব। এই ধরনের বেলায়াত আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, যিনি সৃষ্টিজগত, সৃষ্টি ব্যবস্থা ও এর নিয়ন্ত্রক আইনসমূহের স্রষ্টা।[৩] তাকবিনি বেলায়াত মূলত আল্লাহরই, তবে কিছু লোক মনে করেন যে, বান্দেগীর পথ অনুসরণ করে মানুষ পূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক নৈকট্যের স্তরে পৌঁছতে পারে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিশ্ব ও মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।[৪]
  • তাশরিয়ি বেলায়াত: এই ধরনের বেলায়াত হল শরিয়তের সীমার মধ্যে বেলায়াত, যা আল্লাহর বিধানের অধীন এবং প্রথাগত ও চুক্তিভিত্তিক বিষয়ে কর্তৃত্বের একটি ধরন।[৫] এই ধরনের বেলায়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে সামাজিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানিক পদমর্যাদা হিসেবে নির্বাচিত একটি দলকে প্রদান করা হয়।[৬]

নবী (সা.) ও আহলে বাইতের (আ.) বেলায়াত

আল্লাহর বেলায়াত, তা তাকবিনি হোক বা তাশরিয়ি, সত্ত্বাগত বেলায়াত; কারণ আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের মালিক ও কর্তৃত্বাধিকারী এবং তাঁর অনুমতি ছাড়া কারো কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। অনেকে বিশ্বাস করেন, আল্লাহ তাকবিনি ও তাশরিয়ি বিষয়ে এই অনুমতি নবী করিম (সা.) এবং মাসুম ইমামদেরকে (আ.) প্রদান করেছেন।[৭]

শিয়া কালামশাস্ত্রবিদগণ মনে করেন যে, সকল নবী (আ.) ওলি (কর্তৃত্বের অধিকারী) ছিলেন না এবং কুরআনের আয়াত অনুযায়ী কেবল কয়েকজন নবী-রাসূল, যেমন মহানবী (সা.) এবং হযরত ইবরাহিম (আ.), এই মর্যাদায় পৌঁছেছিলেন।[৮] তারা আরও বিশ্বাস করেন যে, করুণার নীতির (লুতফের কায়দার) ভিত্তিতে ওলি নির্ধারণ করা আল্লাহর উপর ওয়াজিব।[৯]

ফকিহের নিরঙ্কুষ বেলায়াত (বেলায়াতে ফকিহ)

বেলায়াতে ফকিহের অর্থ হল যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদের তত্ত্বাবধান, কর্তৃত্ব এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের বিষয়াদিতে তার নিয়ন্ত্রণ এবং ইসলামি আহকাম বাস্তবায়ন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামি উম্মাহর নেতৃত্ব।[১০] বেলায়াতে ফকিহের উল্লিখিত বেলায়াত তাকবিনি বেলায়াত নয়; বেলায়াতে ফকিহে যে বেলায়াতের কথা বলা হয়, তা তাশরিয়ি বেলায়াতের অন্তর্ভুক্ত, যা একটি প্রথাগত বিষয় এবং আল্লাহ তা'আলা যোগ্য ব্যক্তিদের এই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।[১১] এই বেলায়াত নবী করিম (সা.) ও মাসুম ইমামদের (আ.) বেলায়াতের অধীনস্ত এবং এটি শাসন ও সমাজ পরিচালনার বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত। এটি ব্যক্তিগত বিষয়াদি এবং মাসুম (আ.)-এর বিশেষ অধিকারভুক্ত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে না।[১২]

ইরফানে (অধ্যাত্মবাদে) বেলায়াত

আরেফদের (আধ্যত্মিক জ্ঞানী বা আধ্যাত্মিকতা চর্চাকারীদের) পরিভাষায় বেলায়াত শব্দটি আল্লাহর নৈকট্যে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এবং এটি তাকবিনি বেলায়াতের অন্তর্ভুক্ত। যখন বান্দা নিজের অস্তিত্ব থেকে ফানা (বিলীন) হয়ে যায় এবং তার স্থায়িত্ব কেবল আল্লাহর স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন সে আল্লাহর বেলায়াত লাভ করে। এই অবস্থায়, আল্লাহ এই বান্দার বিষয়াদি নিজের দায়িত্বে নিয়ে নেন যাতে তাকে নৈকট্যের স্তরে পৌঁছাতে পারেন। যখন বান্দার মধ্যে বেলায়াতের পূর্ণ অর্থ বাস্তবায়িত হয়, তখন আল্লাহর প্রতি বান্দার কিয়ামের পাশাপাশি, তার চরিত্র ঐশী চরিত্রে রূপান্তরিত হয় এবং ঐশী গুণাবলি তার মধ্যে প্রকাশিত হয়। এমনভাবে যে, তার জ্ঞান ঐশী জ্ঞান, তার শক্তি ঐশী শক্তি এবং তার কর্ম ঐশী কর্মে পরিণত হয়।[১৩]

আরেফরা বিশ্বাস করেন যে, এই অবস্থায় বান্দা কুরবে নাওয়াফেল হাদিসের প্রতিফলন হয়ে ওঠে: «আল্লাহ বলেন:... আমার বান্দা নফল নামাযের মাধ্যমে ক্রমাগত নিজেকে আমার নিকটবর্তী করে, যতক্ষন না আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দ্বারা সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই যা দ্বারা সে দেখে, তার জিহ্বা হয়ে যাই যা দ্বারা সে কথা বলে, এবং তার হৃদয় হয়ে যাই যা দ্বারা সে চিন্তা করে। যখন সে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দিই এবং যখন সে আমার কাছে কিছু চায়, আমি তাকে দান করি।»[১৪]

তথ্যসূত্র

  1. রাগিব ইসফাহানি, হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ, আল-মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, তাহকিক সাফওয়ান আদনান আদ-দাউদি, দামেস্ক, দারুল ক্বালাম ও আদ-দার আশ-শামিয়া, ১৪১২ হিজরি, পৃষ্ঠা ৮৮৫।
  2. মোতাহারি, ওয়ালা-হা ওয়া ওয়ালায়াত-হা, পৃষ্ঠা ১৫।
  3. ↑ মিসবাহ ইয়াজদি, মুহাম্মদ তাকি, নিগাহি গুজরা বে নাযারিয়ায়ে ওয়ালায়াতে ফকিহ, কুম, মুআসসাসায়ে আমুজেশি ওয়া পژুহেশি ইমাম খোমেইনি, ১৩৮২ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ৭৯।
  4. সুবহানি, জাফর, ওয়ালায়াতে তাশরিঈ ওয়া তাকউইনি দার কুরআনে মাজিদ, কুম, মুআসসাসায়ে ইমাম সাদিক (আ.), ১৩৮৫ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ২৬।
  5. জাওয়াদি আমুলি, ওয়ালায়াতে ফকিহ ওয়ালায়াতে ফিকাহাত ও আদালাত, পৃষ্ঠা ১২৭।
  6. সুবহানি, জাফর, ওয়ালায়াতে তাশরিঈ ওয়া তাকউইনি দার কুরআনে মাজিদ, কুম, মুআসসাসায়ে ইমাম সাদিক (আ.), ১৩৮৫ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ১৭।
  7. হাসানজাদেহ, হাসান, ইনসানে কামেল আজ দিদগাহে নাহজুল বালাগা, কুম, ইন্তিশারাতে কিয়াম, ১৩৭২ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৯।
  8. মোতাহারি, মুরতাজা, ইমামাত ওয়া রাহবারি, তেহরান, ইন্তিশারাতে সাদরা, ১৩৯৬ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ১৬৭-১৬৯।
  9. তুসি, নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ, তালখিসুল মুহাসসাল, বৈরুত, দারুল আদওয়া, ১৪০৫ হিজরি, পৃষ্ঠা ৪০৭।
  10. জাওয়াদি আমুলি, আবদুল্লাহ, ওয়ালায়াতে ফকিহ ওয়ালায়াতে ফিকাহাত ওয়া আদালাত, কুম, ইন্তিশারাতে আসরা, ১৩৭৮ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ১২৯।
  11. মিসবাহ ইয়াজদি, মুহাম্মদ তাকি, নিগাহি গুজরা বে নাযারিয়ায়ে ওয়ালায়াতে ফকিহ, কুম, মুআসসাসায়ে আমুজেশি ওয়া পژুহেশি ইমাম খোমেইনি, ১৩৮৮ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০।
  12. জাওয়াদি আমুলি, ওয়ালায়াতে ফকিহ, ১৩৭৮ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ১২৯।
  13. রুহানি নেজাদ, হোসাইন, ওয়ালায়াত দার ইরফান, তেহরান, সাজমান-এ ইন্তিশারাত পژুহেশগাহে ফারহাঙ্গ ওয়া আন্দিশায়ে ইসলামি, ১৩৮৫ হিজরি শামসি, পৃষ্ঠা ৩৫।
  14. মুহাম্মদি রে শহরি, মুহাম্মদ, মিযানুল হিকমাহ, তরজুমা হামিদ রেজা শেখি, কুম, মুআসসাসায়ে ইলমি ফারহাঙ্গি দারুল হাদিস, সাজমান-এ চাপ ওয়া নাশর, ১৩৮৯ হিজরি শামসি, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৩৮৪।

টেমপ্লেট:تکمیل مقاله