ইসলাম ধর্মের মূলনীতি (উসুলে দ্বীন)
ইসলাম ধর্মের মূলনীতিসমূহ কী কী?
ইসলাম ধর্মের মূলনীতি (উসুলে দ্বীন) হিসেবে তাওহীদ, নবুওয়াত এবং মাআদ বা কিয়ামতকে গন্য করা হয়। বলা হয় যে, এই তিনটি মূলনীতি হচ্ছে ধর্মের ভিত্তি এবং স্তম্ভ। শিয়া পণ্ডিতগণ এই তিনটি মূলনীতির সাথে আদল ও ইমামত নামক আরও দুটি মূলনীত যোগ করেছেন। ফলে, শিয়াদের নিকট উসুলে দ্বীন হচ্ছে মোট পাঁচটি। উসুলে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং অবিশ্বাস মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়।
উসুলে দ্বীন পরিভাষাটি কুরআন বা হাদিসে উল্লেখিত হয় নি। কিছু কিছু কালামশাস্ত্রবিদগণ এই পরিভাষাটি’র নামকরণ করেছেন। উসুলে দ্বীন শব্দটির কখন উৎপত্তি ঘটেছে এবং কে এর নামকরণ করেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। উক্ত পরিভাষাটির প্রবর্তকদের মতে, এই আকীদাগুলোকে উসুলে দ্বীন হিসেবে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে হাদিস, ফিকহ এবং কুরআনের তাফসীরের মতো ধর্মীয় জ্ঞানের শাখাগুলো এই মূল নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
পরিভাষাটির ইতিহাস
উসুলে দ্বীন (ধর্মের মূলনীতিসমূহ) পরিভাষাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। ইসলাম ধর্মের চিন্তা-চেতনার ইতিহাসে পরিভাষাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, কুরআনে এবং শিয়া এবং সুন্নিদের হাদিসগুলোতে ধর্মীয় জ্ঞানের শ্রেনী-বিভাগ হিসেবে উসুল (মূলনীতি) এবং ফুরুঅ (শাখা) বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। এই বিষয়টি এটাই প্রমাণ করে যে, এই পরিভাষা দুটি কিছু কিছু কালামশাস্ত্রবিদ দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছে।
ইবনে তায়মিয়া’র (মৃত্যু: ৭২৮ হিজরি) মতো কিছু মুসলিম পণ্ডিত, যারা মূলত কালামশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শনশাস্ত্রকে ধর্ম ও দ্বীনদারির ক্ষেত্রে বিরোধী বলে মনে করেন, তারা এ প্রসঙ্গে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন, এই কারণে যে, উসুলে দ্বীন কুরআন বা হাদিসের কোন পরিভাষা নয়, এরূপ পরিভাষার প্রবর্তনকে মহানবী (স.) এর শিক্ষার পরিপন্থী হিসেবে মনে করেন।
উসুলে দ্বীন শব্দটির উৎপত্তি কখন ঘটেছে এবং কে এর নামকরণ করেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ইবনে নাদিমও উসুলে দ্বীন শিরোনামে আবু মুসা মুরদারের লেখা একটি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে এই শব্দটি প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত ছিল।[১]
অবস্থান ও গুরুত্ব
ইসলামের আকীদাগত মূলনীতি অর্থাৎ তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ), নবুওয়াত এবং মাআদ বা কিয়ামতের প্রতি ঈমান ও আকীদা। এই তিনটি মূলনীতি ইসলাম ধর্মের ভিত্তি ও স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এমনভাবে যে, এই ধর্মে বর্ণিত হওয়া সবকিছুই মূলনীতিগুলোর একটির মাধ্যমে অথবা তিনটির মাধ্যমেই অর্থবহ হয়ে ওঠে। সুতরাং, ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আসা সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে অল্প-বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এই মূলনীতির ক্ষেত্রে তারা সকলেই একমত।[২]
ইমামিয়া শিয়া কালামশাস্ত্রবিদগণে ধর্মের মূলনীতির সংখ্যা কয়টি এবং কোন কোন বিষয় এর অন্তর্ভূক্ত তা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হল এই যে, উসুলে দ্বীনের মধ্যে নামায, রোযা, মাআদ তথা কিয়ামত এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভূক্ত। তবে, আদল ও ইমামতকেও মাযহাবের মূলনীতি হিসেবে যোগ করতে হবে।[৩] এই মূল নীতিগুলির প্রতি অজ্ঞতা বা বিশ্বাসের অভাব ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। একইভাবে, মাযহাবের মৌলিক নীতিগুলির প্রতি অজ্ঞতা বা বিশ্বাসের অভাব একজন ব্যক্তিকে শিয়া মাযহাব থেকে খারিজ তথা বহিষ্কার করে দেয়।[৪]
অধিকাংশ মুসলিম পণ্ডিত মনে করেন যে, উসুলে দ্বীনের ক্ষেত্রে তাক্বলীদ (অনুসরণ) করা জায়েয বা বৈধ নয়। উসুলে দ্বিনের ক্ষেত্রে মানুষকে অবশ্যই দলিল প্রমাণের মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। । এই বিষয়টির উপর আলেমদের মধ্যে ইজমা তথা ঐক্যমতের দাবি করা হয়েছে। তবে, অন্য একদল যেমন আবু হানিফা, সুফিয়ান থুরী, আওযায়ী, মালিক, শাফেয়ী, আহমাদ ইবন হাম্বাল এবং আহলে হাদিসের অনুসারীরা মনে করেন যে, যদিও মৌলিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যুক্তি-প্রমাণ থাকা ওয়াজীব তথা বাধ্যতামূলক এবং তা ত্যাগ করা পাপ হিসেবে গণ্য হয়, তবে তাক্বলীদ বা অনুকরণের ভিত্তিতে ঈমান গ্রহণযোগ্য।[৫]
অনেক ধর্মীয় পণ্ডিতের মতে, ধর্মের মূলনীতি সমূহের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া ব্যক্তির মুসলিম হওয়া সম্ভব নয় এবং এগুলির মধ্যে কোন একটা অস্বীকার করলে কাফির হিসেবে গণ্য এবং শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবেন। উক্ত পরিভাষাটির প্রবর্তকদের মতে, এই আকীদাগুলোকে উসুলে দ্বীন হিসেবে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে হাদিস, ফিকহ এবং কুরআনের তাফসীরের মতো ধর্মীয় জ্ঞানের শাখাগুলো এই মূল নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বলা হয় যে, ধর্ম হচ্ছে একটি শিকরড় বিশিষ্ট গাছের ন্যায়, আর উসুলে দ্বীন হচ্ছে ধর্মের শিকড়, যার অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে গাছের জীবন।[৬]
উসুলে দ্বীনের উদাহরণ
তাওহীদ (একত্ববাদ)
তাওহীদ হল ইসলাম ধর্মে আকীদা-বিশ্বাসের সবচেয়ে মৌলিক শিক্ষা, যার তাত্ত্বিক এবং কার্যকরী বিভিন্ন দিক রয়েছে। তাওহীদের অর্থ অনুসারে, আল্লাহ একক ও অ-দ্বিতীয় সত্ত্বা, সমস্ত গুণাবলী পূর্ণাঙ্গ রূপে তার মধ্যে বিদ্যমান, তার সমতুল্য ও সমকক্ষ কেউ নেই, পরিবর্তনহীন, সমস্ত জগতের একমাত্র স্রষ্টা এবং তার কোন শরীক নেই। মহাবিশ্বের পরিচালনা তাঁর ইরাদা বা ইচ্ছার মাধ্যমে সংঘটিত হয়, এবং তাঁর জ্ঞান এবং ক্ষমতা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। সমস্ত সৃষ্টির অবশ্যকরণীয় হচেছ তাঁকে উপাসনা করা, যে উপাসনা কোনো মধ্যস্থতার মুপাপেক্ষীতা ছাড়াই। কুরআন অনুযায়ী, আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস মানুষের ফিতরাত ও স্বভাব-প্রকৃতিতে নিহিত। আর একত্ববাদ ব্যতীত যেকোন বহুত্ববাদের আকীদা ও বিশ্বাস হচ্ছে বিচ্যুত চিন্তাধারা, আর এই বিচ্যুত চিন্তাধারা মানসিক, পরিবেশগত, ভৌগোলিক বা ঐতিহাসিক কারণ থেকে উৎসারিত হয়। সমস্ত নবীগণ (আ.) ছিলেন তাওহীদের দিকে আহ্বানকারী এবং তাদের বেশীরভাগই শিরক, বহু ইশ্বরবাদী ধর্ম এবং মূর্তিপূজা বিলুপ্ত করায় সচেষ্ট ছিলেন।[৭]
নবুওয়াত
নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস অর্থ হল যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর প্রেরিত প্রতিনিধি। তাঁকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কুরআন হল আল্লাহর বানী যা তাঁর উপর ওহী করা হয়েছে।[৮]
মাআদ
মআদ শব্দটির অর্থ ফিরে আসা। কালামশাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিকদের মতানুসারে, মাআদ বলতে মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে বুঝায় অর্থাৎ মানুষকে যখন পুনরায় জীবিত করা হবে। মআদ সেই দিনকে বলা হয়, যেদিন মানুষের কাজগুলির মূল্যায়ন করা হবে, সৎ ব্যক্তিরা তাদের ভাল কাজের জন্য পুরস্কৃত হবেন এবং পাপী ব্যক্তিরা তাদের খারাপ কাজের জন্য শাস্তি পাবেন। ধর্ম, কালামশাস্ত্রবিদদের ও দর্শনে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি দেরীতে লক্ষ্য করা হয়েছে সেটি হচেছ মৃত্যু পরবর্তী জীবনের বিষয় এবং মাআদ। ধর্মবিশ্বাসীরা মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা পরকালকে তাদের বিশ্বাসের মৌলিক একটি ভিত্তি হিসেবে মনে করেন।[৯]
আদল (আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা)
যদিওবা আদল তথা ন্যায়বিচার সংক্রান্ত সিফাতটিও (গুণ) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অন্যতম কর্ম গুণ। তবে এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বিষয়টি নিয়ে আশআরী, শিয়া এবং মু'তাযিলীদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের কারণে। আর এর ফলে শিয়ারা এবং মু'তাযিলীরা আদলিয়া (আল্লাহর ন্যায়বিচারের সমর্থক) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; এভাবেই ধীরে ধীরে ন্যায়বিচার নামক মূলনীতিটিও ইমামতের পাশাপাশি শিয়া মাযহাবের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আল্লাহর অনেক কর্ম গুণ (সিফাতে ফে’লি) আসলে আদলের সাথে সম্পর্কিত। আদল তথা ন্যায়বিচারের বিস্তৃত ধারণা বিবেচনা করে, যার মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অন্তর্ভূক্ত, এরূপ আকীদার মূলনীতিকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে তুলে ধরাটাই যথার্থ।[১০]
ইমামত
ইমামত একটি ঐশ্বরিক দায়িত্ব। শুধুমাত্র ওহী প্রাপ্তি ও এর অনুরূপ কিছু ব্যতীত নবীদের সমস্ত দায়িত্ব ইমামদের (আ.) জন্যও নির্ধারিত। এই দিক থেকে, নিষ্পাপতা যেমন নবুওযোতের শর্ত তেমন ইমামতের ক্ষেত্রেও শর্ত। এই পার্থক্যের কারণেই আমরা ইমামতকে উসুলে দ্বীনের অংশ হিসেবে মনে করবো।[১১] ইমামত নিঃসন্দেহে ইমামিয়া শিয়াদের কালাম বিষয়ক চিন্তাধারায় কেন্দ্রীয় স্থানের অধিকারী। শিয়ারা একদিকে ইমামদের ঐশ্বরিক মনোনয়ন (নাস) এবং নিষ্পাপতায় (ইসমাত) বিশ্বাস করে, অন্যদিকে ইমামদের ইমামদের একচেটিয়া ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি আকীদা পোষণ করে, আর এই বিষয়টি হতে পারে এই পদের গুরুত্ব নির্দেশ করার মাধ্যম।[১২]
সম্পর্কিত নিবন্ধ
তথ্যসূত্র
- ↑ গযাশতে, নাসের, "উসূল উদ-দীন", দানেশনামায়ে ইরান, তেহরান, মারকায দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, খ:৪, জিল মাদখাল।
- ↑ জামি'য়ে আয নেভেসান্দেগান, "ইসলাম", দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, তেহরান, মারকায দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, খ:৮, জিল মাদখাল।
- ↑ গযাশতে, নাসের, "উসূল উদ-দীন", দানেশনামায়ে ইরান, তেহরান, মারকায দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, খ:৪, জিল মাদখাল।
- ↑ জামি'য়ে আয মোহাক্কেকিন, "উসূল উদ-দীন", দানেশনামায়ে কালামে ইসলামী, পৃ:৫১।
- ↑ জামি'য়ে আয মোহাক্কেকিন, "উসূল উদ-দীন", দানেশনামায়ে কালামে ইসলামী, পৃ:৫১।
- ↑ গযাশতে, নাসের, "উসূল উদ-দীন", দানেশনামায়ে ইরান, তেহরান, মারকায দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, খ:৪, জিল মাদখাল।
- ↑ তারেমি রাদ, হাসান, ও দিগেরান, "তাওহীদ", দানেশনামায়ে জাহানে ইসলাম, বুনিয়াদে দায়েরাতুল মাআরিফে ইসলামী, ১৩৯৩ শামসি, খ:৮, জিল মাদখাল।
- ↑ জামি'য়ে আয নেভেসান্দেগান, "ইসলাম", দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, তেহরান, মারকায দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, খ:৮, জিল মাদখাল।
- ↑ সাজাদী, জাফর, ফারহাঙ্গে মাআরিফে ইসলামী, খ:৩, পৃ:১৮১৫।
- ↑ "আদল আয উসূল উদ-দীন", পাইগাহে এট্তেলাআর-রেসানিয়ে দফতারে আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাযী, এন্তেশার: ১০ মেহর ১৩৯৭ শামসি, বাযদীদ: ৯ আবান ১৪০২ শামসি।
- ↑ "তারিফে ইমামত", পাইগাহে এট্তেলাআর-রেসানিয়ে দফতারে আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাযী, এন্তেশার: ২৯ ফররদিন ১৩৯৫ শামসি, বাযদীদ: ৯ আবান ১৪০২ শামসি।
- ↑ আনসারী, হাসান, "ইমামত", দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, তেহরান, মারকাযে দায়েরাতুল মাআরিফে বোজুরগে ইসলামী, জিল মাদখাল।